মতামত

পুঁজিবাজার ও প্রধান দুটি সমস্যা

তানভীর আহমেদ

বর্তমান পুঁজিবাজারে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা জানার জন্য খুব একটা কষ্ট করার দরকার হয় না। পুঁজিবাজারে কান পাতলেই শুনতে পারবেন বিনিয়োগকারীদের কান্না। বিনিয়োগকারীদের আর্তচিৎকার। ব্রোকারেজ হাউজ গুলোতে গেলে এখন আর বিনিয়োগকারীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। দুই একজনকে খুঁজে পাওয়া গেলেও তাদের সাথে কথা বলেলেই জানতে পারবেন তাদের জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গত ১০ মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ইনডেক্স কমেছে ২৭% আর বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়েছে প্রায় ৭৫%। আর যাদের ঋণ নিয়ে শেয়ার কেনা তাদের টাকা ঋণাত্মক হয়ে গেছে। বাজারের এই অবস্থায় যাদের হাতে শেয়ার রয়েছে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে।

গত ৯ বছরে পুঁজিবাজারে ৯৭টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪৬টি কোম্পানির শেয়ারের দাম তার ইস্যু মূল্যের নিচে লেনদেন হচ্ছে। যা শতকরা হিসেবে ৪৭%। বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। গত ৯ বছরে পুঁজিবাজারে যে অনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়েছে তার ফলাফল ভোগ করছে পুঁজিবাজার। বর্তমানে ৩২০টি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আছে। এর মধ্যে ৫৮টি কোম্পানির দাম এখন ১০ টাকার নিচে অর্থাৎ অভিহিত মূল্যের নিচে আছে। যা বাজারে তালিকাভুক্ত মোট কোম্পানির ২০ শতাংশ। পুঁজিবাজারের ইতিহাসে এতো বিপুল সংখ্যক কোম্পানি এর আগে কখনও অভিহিত মূল্যের নিচে ছিল না।

বর্তমান পুঁজিবাজারের প্রধান সমস্যা ২টি। ১) আস্থার অভাব ২) অর্থ সংকট দ্বিতীয় সমস্যার অন্যতম কারন কিন্তু প্রথম সমস্যাটি। আমরা কি চিন্তা করে দেখেছি আস্থার অভাবটা আসলে কি? কি কারণে আস্থার অভাব? কাদের জন্য এই আস্থার অভাব? মানুষ যখন নিজে থেকে সমস্যার সমাধান না করে তখন প্রকৃতি নিজে সেখানে হস্তক্ষেপ করে। আর প্রকৃতির হস্তক্ষেপ হয় মর্মান্তিক।

পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় এই আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক বছর থেকেই পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার উপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট দেখা দেয়। যা বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ করেছে। দুর্বল আইপিও অনুমোদন, কারসাজি চক্রকে শাস্তির আওতায় না আনা, আবার কখনও কখনও শাস্তির নামে অল্প টাকা জরিমানা করে কারসাজি চক্রকে পুরস্কৃত করেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। অতীতে এর আগে কোন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ প্রাপ্ত হননি। সেখানে বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যান তৃতীয় মেয়াদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। যা পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা ভালো ভাবে গ্রহণ করেননি। শুধু তাই না এই কমিশনের সময় কালেই পুঁজিবাজারের স্বল্প মূলধনী দুর্বল কোম্পানি গুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি কারসাজি হয়েছে। এই সময় কালেই দুর্বল কোম্পানি গুলো তার ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড গড়েছে। যা পুঁজিবাজারের উপর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে এই কমিশন কখনই শক্ত ভূমিকা পালন করতে পারেনি। সম্মিলিত ভাবে কোম্পানির ডিরেক্টরদের ৩০% শেয়ার ধারণ করার আইনটি আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সর্বোপরি বিনিয়োগকারীরা এই বাজারে তাদের অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কিত ছিল। আর সেই শঙ্কা থেকেই আস্তে আস্তে আস্থার সংকট দেখা দেয়। যা সরকারের উপর মহল অবগত থাকলেও এই বিষয় গুলোর উপর কার্যত কোন পদক্ষেপ নেয়নি। যা বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি শঙ্কিত করে তুলে। বর্তমান পুঁজিবাজারের যে চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি তা সেই আস্থার সংকটের বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজিবাজারের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে যাদের জন্য এই আস্থার সংকট তাদের সরিয়ে দিতে হবে। বিএসইসি এবং ডিএসই কে ঢেলে সাজাতে হবে। বিএসইসির কমিশনারগণ ছাড়াও যারা এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রয়েছেন তাদেরকেও ঢেলে সাজাতে হবে। যে কোম্পানির শেয়ার গুলো ইস্যু মূল্যের নিচে অবস্থান করছে সেই কোম্পানি গুলোর জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। আর এর জন্য দায়ী কর্তাব্যক্তিদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে।

বর্তমান পুঁজিবাজারে যে আস্থার সংকট চলছে, এই অবস্থায় ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের অর্থ পুঁজিবাজারে আসার সম্ভাবনা নেই। তাই এই পরিস্থিতিতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। পদ্ধতি যাই হোক, যত দ্রুত সম্ভব পুঁজিবাজারে অর্থের যোগান দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকার নিজেই শেয়ার কিনতে পারে অথবা মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউজ গুলোকে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ হিসেবেও দিতে পারে। ৫২০০ ইনডেক্স থেকে বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছে শেয়ারের দাম তলানিতে। বাজার এখন নিজস্ব শক্তিতে ঘুরে দাঁড়াবে। অথচ ইনডেক্স এখন ৪৩৯৫। প্রশ্ন হচ্ছে পুঁজিবাজারের কি প্রাণ আছে? যদি না থাকে তাহলে নিজস্ব শক্তিতে কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবে? পুঁজিবাজারের প্রাণ পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। যাদের মেরে ফেলা হয়েছে। তাই পুঁজিবাজার নিজস্ব শক্তিতে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। আর নুতন বিনিয়োগকারী সৃষ্টি করতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর এই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বিএসইসি এবং ডিএসই কে ঢেলে সাজানো ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।

এইচআর/পিআর