দেশের বিভিন্ন খাতে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অবৈধ অর্থের বিরুদ্ধে গত সেপ্টেম্বরে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করে আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন বাহিনী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান এসব অভিযানের নেতৃত্ব দেয় এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এছাড়া পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরও অভিযান চালায়। সারাবছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিরাপত্তা বাহিনী তৎপর থাকলেও ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, মাদক এবং অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে পরিচালিত এ ‘শুদ্ধি অভিযান’।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ এবং মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের পর সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতেই তিনি দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।’ জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দলের কে, কী- সেটা আমি দেখতে চাই না। আমার আত্মীয় পরিজন- আমি দেখতে চাই না। কে কত বেশি উচ্চবিত্ত সেটা আমি দেখতে চাই না। অনিয়ম যেখানে আছে, দুর্নীতি যেখানে আছে, বা আমাদের দেশকে ফাঁকি দিয়ে যারা কিছু করতে চাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত এ অভিযান ক্ষমতাসীন দলতো বটেই, সংসদের বিরোধী দল থেকে শুরু করে প্রায় সব রাজনৈতিক দলেরই সমর্থন পায়। সরকারপ্রধানকে প্রশংসায় ভাসায় সাধারণ জনগণ, সুশীল সমাজ এবং সংবাদমাধ্যমও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। তবে অনেকে বলছেন, শুদ্ধি অভিযান হওয়া উচিত সকল অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি দলের ভেতর থেকে নিজেদের আত্মশুদ্ধিরও উদ্যোগ নিতে হবে। আত্মশুদ্ধি না হলে একসময় শুদ্ধি অভিযানও মুখ থুবড়ে পড়বে।
দুর্নীতি-অনৈতিক কারবারের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই সতর্কতা দিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে অ্যাকশন শুরু হয় সেপ্টেম্বরের শেষার্ধে। প্রথমে রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে র্যাব। এ অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট সহ গ্রেফতার করা হয় ২১ জনকে। নগদ প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকার পাশাপাশি জব্দ করা হয় প্রায় ১৬৬ কোটি টাকার এফডিআর, বিভিন্ন ব্যাংকের ১৩২টি চেক বই এবং ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক। জব্দ করা হয় চার কোটি টাকা মূল্যের আট কেজি স্বর্ণ। বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগে এবং অবৈধ অস্ত্র হিসেবে মোট ২৮টি আগ্নেয়াস্ত্রও জব্দ করা হয়। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণে ইয়াবা ও বিদেশি মদও জব্দ করা হয়। ক্লাবগুলোতে পাওয়া যায় ক্যাসিনো পরিচালনার নানা সামগ্রীও।
আদালতে নেয়া হচ্ছে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে
ধরা খেলেন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, ক্লাবে ক্লাবে র্যাবের হানা
অভিযান শুরু গত ১৮ সেপ্টেম্বর। ওইদিন বিকেলে ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব। এরপর একে একে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ ক্লাবে হানা দেয় এই এলিট ফোর্স। অভিযানে সন্ধান মেলে অবৈধ ক্যাসিনোর। ওই রাতেই ইয়ংমেনস ক্লাবের মালিক ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে তার গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেফতার করেন র্যাব সদস্যরা। পরে খালেদকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
র্যাবের হাতে আটক জি কে শামীম
র্যাবের জালে ‘টেন্ডার শামীম’
২০ সেপ্টেম্বর র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন যুবলীগ নেতা পরিচয়দানকারী ‘টেন্ডারবাজ’ খ্যাত জি কে শামীম। জি কে বিল্ডার্সের এই মালিককে গ্রেফতার করার সময় তার অফিস থেকে নগদ এক কোটি ৮০ লাখ টাকা ও ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর উদ্ধার করা হয়। রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় জি কে শামীম প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গণপূর্ত ভবনের বেশিরভাগ ঠিকাদারি কাজ জি কে শামীম নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাকে গ্রেফতার এবং তার অফিসে অভিযান পরিচালনা না করতে সেসময় র্যাবকে ১০ কোটি দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন জি কে শামীম।
প্রভাবশালী এ ঠিকাদারকে ধরার পর সেই রাতে রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ও ধানমন্ডি ক্লাবেও অভিযান চালানো হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি ও কৃষকলীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজকে।
আদালতে নেয়া হচ্ছে বিসিবির লোকমানকে
গ্রেফতার বিসিবির লোকমান, প্লেন থেকে নামিয়ে ধরা হয় সেলিমকে
গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর মনিপুরী পাড়ার বাসায় অভিযান চালিয়ে মাদকসহ গ্রেফতার করা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইন-চার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে। ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় থাইল্যান্ডগামী এক প্লেন থেকে নামিয়ে ধরা হয় অনলাইন ক্যাসিনোর জনক সেলিম প্রধানকে।
র্যাবের অভিযানের মধ্যে তেজগাঁওয়ের ফু-ওয়াং ক্লাবে অভিযানে যায় পুলিশ। তারা অভিযানে কিছু না পাওয়ার কথা বললেও দুদিন পর একই ক্লাবে ২৬ সেপ্টেম্বর র্যাব অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদক পাওয়ার কথা জানায়।
র্যাবের হাতে আটক সেলিম প্রধান
ধরা পড়লেন ‘ক্যাসিনো সম্রাট’
শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের নাম। ক্যাসিনোগুলোতে তার প্রভাবের কারণে এ যুবলীগ নেতার পরিচিতি ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ হয়ে যায় বলেও খবর প্রকাশ হয়। শেষতক ৬ অক্টোবর সম্রাট ও তার সহযোগী এমরানুল হক আরমানকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীতে তার অফিস ও কয়েকটি বাসায় অভিযান চালানো হয়। সম্রাট ধরা পড়ার পর তাকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
র্যাবের হাতে আটক ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট
অভিযানে খালেদ মাহমুদ ভুইয়া ও ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের অফিসে [টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখান থেকে নির্যাতনে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার লাঠি ও ইলেকট্রিক শক দেয়ার মেশিন জব্দ করা হয়।
ঢাকার বাইরে অভিযান, গ্রেফতার পাগলা মিজান
গত ১১ অক্টোবর ভোরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের কলেজ গেট এলাকায় কথিত এক বান্ধবীর বাসা থেকে একটি অবৈধ পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগজিন ও নগদ দুই লাখ টাকাসহ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন। পরে তার বাসা ও কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে মোট ৭ কোটি ৬৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার চেক ও এফডিআর জব্দ করে র্যাব।
গ্রেফতার ‘মোহাম্মদপুরের সুলতান’
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর আত্মগোপনে চলে যান ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক তারেকুজ্জামান রাজীব। কিন্তু ১৯ অক্টোবর রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। নিজেকে ‘মোহাম্মদপুরের সুলতান’ হিসেবে পরিচিত রাজীবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ, বসিলা এলাকার পরিবহনে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ এবং এলাকার কোরবানির পশুর হাটের ইজারা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি প্রায় শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাসায় অভিযান
গত ২৭ অক্টোবর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর অভিযান চালায় বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গুলশানের বাসায়। সেখানে ক্যাসিনো সামগ্রী এবং বিপুল পরিমাণ মদ, সিসা ও বিয়ার জব্দ করা হয়। গ্রেফতার করা হয় আজিজের ভাতিজা ওমর মোহাম্মদ এবং ওই বাড়ির দুই কেয়ারটেকার নবীন ও পারভেজকে। অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়, আজিজ মোহাম্মদের বাসা যেন হয়ে উঠেছিল মিনি বার।
গ্রেফতার কাউন্সিলর ময়নুল
গত ৩১ অক্টোবর টিকাটুলির নিজ কার্যালয় থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জুকে গ্রেফতার করে র্যাব। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি চাঁদাবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেছেন এবং সেসব অর্থ আমেরিকায় বসবাসরত পরিবারের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন। অভিযানে তার কার্যালয় থেকে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র, মাদক ও নিষিদ্ধ ওষুধও উদ্ধার করা হয়।
র্যাব সদর দফতরের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে র্যাব ১১টি ক্যাসিনো ও ক্লাবে অভিযান পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে ঢাকার আটটি এবং চট্টগ্রামের তিনটি ক্লাবে চালানো হয়েছে অভিযান। এসব ক্লাব থেকে উদ্ধার ক্যাসিনো সামগ্রীর দাম প্রায় কয়েক কোটি টাকা।
যা বলছেন কর্মকর্তারা
শুদ্ধি অভিযান সম্পর্কে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম জাগো নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর আমরা ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করেছিলাম। এ অভিযানের ফলে এখন সারাদেশের কোথাও অবৈধ ক্যাসিনো নেই। এর সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট অনেক হর্তা-কর্তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু করেছিলাম, সেক্ষেত্রে আমরা শতভাগ সফল। অভিযানের পর দায়ের করা মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কারও সম্পৃক্ততা পেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, আইনের মধ্য থেকে ডিএমপি কাজ করছে। কারও বিরুদ্ধে ক্যাসিনো কিংবা মাদকের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও সত্যতা পেলে ডিএমপি ব্যবস্থা নেবে। কারণ মাদকের ব্যাপারে ডিএমপি’র অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’।
জেইউ/এইচএ/এমএআর/পিআর