আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলী আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ক্লিন ইমেজের এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে তার নির্বাচনী এলাকা গাজীপুরের শ্রীপুরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
অ্যাডভোকেট রহমত আলীর ব্যক্তিগত সহকারী এসএম জাহাঙ্গীর আলম সিরাজী জানান, রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অ্যাডভোকেট রহমত আলী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। দীর্ঘদিন তিনি ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে ভুগছিলেন।
এসএম জাহাঙ্গীর আলম সিরাজী আরও জানান, রোববার বাদ জোহর পশ্চিম ধানমন্ডি জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বিকেল ৪টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়, বাদ এশা ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বায়তুল মামুর জামে মসজিদ ও আগামীকাল (সোমবার) দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে মরহুমের জানাজার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও আরও কয়েকটি স্থানে জানাজা হওয়ার কথা রয়েছে। মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) তার জন্মস্থান গাজীপুরের শ্রীপুরে জানাজা শেষে সেখানেই দাফনের কথা রয়েছে।
অ্যাডভোকেট রহমত আলী ১৯৪৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় বড়বাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মো. আছর আলী আর মায়ের নাম শুক্কুরজান বিবি। মৃত্যুকালে রহমত আলী দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। তার বড় ছেলে ড. জাহিদ হাসান তাপস যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক। আর ছোট ছেলে অ্যাডভোকেট মো. জামিল হাসান দুর্র্জয় গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক। তার একমাত্র মেয়ে রুমানা আলী টুসী একাদশ জাতীয় সংসদে ১৪নং সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য।
অ্যাডভোকেট রহমত আলীর রাজনৈতিক সহযোগীরা জানান, রহমত আলীর রাজনৈতিক জীবন ছিল দেশ গড়ার ইতিহাস, তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। তিনি সততা ও আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদের পরম আদর আর ভালোবাসার লড়াকু এই সৈনিকের হাতে কত নেতার যে জন্ম হয়েছে তার হিসেব নেই। অনেককে বুকে জড়িয়ে রেখেই তিনি রাজনীতি শিখিয়েছেন। সবকটা নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলন, ৬৬ এর ৬ দফা, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন অ্যাডভোকেট রহমত আলী। শ্রীপুর-কালিয়াকৈরের মানুষ তাকে ‘উন্নয়নের রূপকার’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। স্বাধীনতার পর এই এলাকায় যতো উন্নয়ন হয়েছে সবগুলো তিনিই করেছেন।
রহমত আলী মাত্র ১১ বছর বয়সে ছাত্রলীগে সক্রিয় হয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে গ্রেফতার হয়ে তিন মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৬ সালে ৭ জুন তেজগাঁও শিল্প এলাকায় মিছিলে নেতৃত্ব দেন এবং গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন।
অ্যাডভোকেট রহমত আলীর সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সদস্য অ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদ ফরিদ জানান, অ্যাডভোকেট রহমত আলী ১৯৬৮ সালে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদের পক্ষে প্রচারণার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটারের সঙ্গে মি. বুশ ও জি এম চ্যাটার্জীর সমন্বয় ও ফ্লাইট কুরিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে ১৯শে এপ্রিল ১৯ সদস্য বিশিষ্ট কৃষক লীগের গঠিত কমিটিতে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শতাধিক বস্তিবাসী পরিবারকে দিনাজপুরে পুনর্বাসিত করেন। ১৯৭৪ সালে কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক হন। ১৯৭৬ সালে ১০ জুলাই মতিঝিলের কমার্শিয়াল কো অপারেটিভ ব্যাংক থেকে গ্রেফতার হন এবং ২ বছর ৮ মাস ১৭ দিন কারাভোগ করেন। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আবার গ্রেফতার হন।
অ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদ ফরিদ আরও জানান, অ্যাডভোকেট রহমত আলী ১৯৮৬ সালে কৃষক লীগের সভাপতি হন। ১৯৯০ সালের ২৯ নভেম্বর গ্রেফতার হন। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর-ভাওয়ালগড়-পিরুজালী-মির্জাপুর) আসন থেকে পরপর পাঁচবার বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৯৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরে থেকে ২০০১ সালের ১৭ জুলাই পর্যন্ত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অ্যাডভোকেট রহমত আলী ১৯৯৬ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর সংসদের বিশেষ কমিটির সভাপতি, ১৯৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বরে স্থানীয় সরকার কমিশনের চেয়ারম্যান হন। এছাড়াও তিনি আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
অ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদ ফরিদ বলেন, অ্যাডভোকেট রহমত আলী জীবনের সব কিছু উজার করে সততা, আন্তরিকতা, দেশপ্রেমের মাধ্যমে বটবৃক্ষের মত ছায়া দিয়ে কর্মী তৈরী করেছেন। এলাকার উন্নয়ন করেছেন। নিরহংকারী, শিক্ষানুরাগী, আদর্শ রাজনীতিবিদ হিসেবে সর্বমহলে তার সুনাম ছিল।
শিহাব খান/আরএআর/পিআর