মতামত

ভারতে সহিংস দাঙ্গা ও বিশ্ববিবেক

দিল্লিতে কি ঘটছে তা আমরা সবাই জানি ও দেখছি। এটা কাম্য নয় কোনোভাবেই। বলা হচ্ছে, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কোনো হত্যাযজ্ঞই আর অভ্যন্তরীণ থাকে না- যখন মানুষের রক্ত মাটি স্পর্শ করে ইয়ামেন,তুরস্ক,ইরাক,ইরান,ভারত, বাংলাদেশ,পাকিস্তান - যে কোনো দেশেই হোক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত সফর করে এসেছেন। ট্রাম্প-মোদী দুজনেই বিশ্বে সন্ত্রাস দমনে যৌথভাবে কাজ করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। এটা কি তবে রক্তের হোলিখেলা বন্ধের পূর্বঘটনা? ট্রাম্প ভারতে কেন গিয়েছিলেন, তা নিয়ে অনেক কথাই হচ্ছে বিশ্বব্যাপি। বিবিসি বলছে, ভারতীয় আমেরিকান ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতেই ট্রাম্পের এই সফর।তারা আরও বলছে, বাণিজ্য চুক্তি,চীনের সাথে গরম-শীতল সম্পর্ক যাচাই, ভারতের সাথে আমেরিকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আদান-প্রদান, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদীকে 'সেফগার্ড' দেয়ার নামে নানা ধরণের সুবিধা নেয়াও ট্রাম্পের লক্ষ্য থাকতে পারে। এগুলো যে আছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় সংকট'টি এখন হচ্ছে ভারতে সাধারণ জনগণের ক্ষেপে উঠার বিষয়টি। এনআরসি সংকট গোটা ভারতকে অশান্ত করে তুলেছে চরমভাবে। ২০১৯ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত শুধু ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের নাম জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাকি অঙ্গরাজ্যগুলোর কথা নাহয় আপাতত বাদই দিলাম।

বিতর্কিত নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়া আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়।নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশকারী অমুসলিমদের নাগরিক হওয়ার অনুমতি দেয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকার বলছে, এর ফলে ভারত ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা মানুষের অভয়াশ্রমে পরিণত হবে। এতে দেখা যাচ্ছে বিজেপি নিজেই সংশোধিত আইন অমান্য করছে। কেন এমনটি করছেন,মোদী-অমিত শাহর সরকার? বিজেপির এক নেতা কপিল মিশ্র নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে সপ্তাহব্যাপী অবস্থান নেয়া বিক্ষোভকারীদের হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত ছাড়ার পরে তাদের জোর করে উচ্ছেদ করা হবে। সেটাই রূপ নিয়েছে সহিংসতায়।

দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরুর পর থেকেই নানা স্পর্শকাতর ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে দেয়া হয় টুইটারসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে। দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হচ্ছে অনেক ফুটেজই ভুয়া।তবে মসজিদে আগুন দিয়ে সেটির মিনারে গেরুয়া রংয়ের পতাকা উড়িয়ে দেওয়ার যে ভিডিও ফুটেজটিকে দিল্লি পুলিশ 'ভুয়া' প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে, বিভিন্ন সূত্র থেকে যাচাই করে তার সত্যতা নিশ্চিত করেছে অল্ট নিউজ নামে অনলাইন-ভিত্তিক একটি নিউজ সাইট। মিডিয়াগুলো লিখছে- 'জয় শ্রীরাম' এবং 'হিন্দুস্তান হিন্দুদের' স্লোগান দিয়ে একদল লোক একটি মসজিদে ভাঙচুর করে কট্টর হিন্দুত্ববাদের প্রতীক একটি গেরুয়া পতাকা মসজিদটির মিনারে উড়িয়ে দিয়েছিল।

এসব কাজ হয়েছে খুবই হীন মন নিয়ে। কারণ একটি রাষ্ট্রে যারা যুগের পর যুগ বাস করে আসছেন, তাদের ধর্ম,বর্ণ, গোত্রকে সামনে এনে এভাবে আক্রমণ কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। নরেন্দ্র মোদী কি তবে রায়টের দিকেই ঠেলে দিতে চাইছেন ভারতকে ? তিনি কি জানেন না- এর পরিণতি কি হতে পারে? ট্রাম্পের ভারত সফরের পরপরই আমরা খবরে দেখেছি, চীন-পাকিস্তানকে রুখতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র কিনবে ভারত। এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর এ দেশটিতে অ্যাপাশে ও এমএইচ-৬০ হেলিকপ্টার বিক্রয়ের চুক্তিতে সম্মত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই হেলিকপ্টারগুলি বিশ্বের মধ্যে উন্নততম।

প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দু’দেশের সম্পর্ক আরও ভাল করতে চুক্তি হচ্ছে উল্লেখ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘এই সফর দু’দেশের কাছেই অত্যন্ত ফলপ্রসূ। আমাদের মধ্যে অ্যাপাশে ও এমএইচ-৬০ হেলিকপ্টার কেনা-বেচার চুক্তি হয়েছে। এই হেলিকপ্টারগুলি বিশ্বের মধ্যে উন্নততম। ইসলামী সন্ত্রাসবাদ রুখতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। একই সঙ্গে সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানের সঙ্গেও নিরন্তর আলোচনা চালাচ্ছে আমেরিকা।’

একদিকে অস্ত্র কিবছে ভারত। অন্যদিকে নিজের দেশের ভেতরেই মানুষকে উসকে দিচ্ছে মানুষের বিরুদ্ধে, মোদী সরকার। ১৯৪৩ এবং ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার কথা ইতিহাসে পড়েন'নি মিঃ নরেন্দ্র মোদী? এর পরের চিত্রগুলোও ছিল আরও ভয়াবহ।১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে তার রেশ চলতে থাকে৷ ১৯৪৮, ১৯৫০ এবং ১৯৫৮-এর দাঙ্গা পূর্ব বাংলাকে বিপর্যস্ত করে৷ শিকার হন প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন৷ আর এর নেপথ্যে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা৷ কিন্তু ধর্মের নামে যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করেছে, হত্যা করেছে তারা জয়ী হতে পারেনি৷ জয়ী হয়েছে মানবিকতা বোধ৷ হিন্দু সম্প্রদায়কে দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে রক্ষা করতে মুসলমানরাই প্রাণ দিয়েছেন৷ যাদের মধ্যে আলতাফ উদ্দিন আহমেদ, আমীর হোসেন চৌধুরী, নিয়াজ আলী মাষ্টার অন্যতম৷ ১৯৫৮ সালের দাঙ্গার বিরুদ্ধে সারা দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল সংবাদপত্র৷ তারা শিরোনাম করেছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও'৷

আজ ভারতেও একই স্লোগান হওয়া উচিৎ,'ভারতবাসী রুখে দাঁড়াও'।কারণ যারা বলছেন এটা ভারতের আভ্যন্তরিণ বিষয়- সমস্যাটি তাদেরই সমাধান করতে হবে। ভারতের নিকট অতীতের দাঙ্গার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখবো ২০০২ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় গুজরাটে দুহাজারেরও বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম। ওই ভয়াবহ দাঙ্গার সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ভারতের এখনকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

পরবর্তী সময়ে, সেনাবাহিনীর এক সাবেক মুসলিম জেনারেল এক সাক্ষতকারে বলেছিলেন- ভারতে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা ঠেকাতে সেনা নামাতে দেরি করা হয়েছিল।সেনাবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান জমিরউদ্দিন শাহ গুজরাট দাঙ্গার মোকাবিলায় মোতায়েন করা সেনাদের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি তার সদ্যপ্রকাশিত বইতে দাঙ্গা ঠেকানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছেন।ভারতের সাবেক উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিও দাঙ্গার সময় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তার বইয়ে।

জমিরউদ্দিন শাহ তার লেখায় লিখেছেন, পুরো রাজ্য জুড়ে তখন চলছে ভয়াবহ দাঙ্গা। কিন্তু তাদের পুরো একটা দিনেরও বেশি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়েছিল। মধ্যরাতের পর তিনি মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে দেখা করতে গিয়েছিলেন - সেখানে তখন ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজও। কিন্তু তার পরেও সেনারা দাঙ্গা ঠেকানোর জন্য রাস্তায় নামতে পারেনি চব্বিশ ঘন্টারও বেশি সময়। সাবেক লে: জেনারেল জমিরউদ্দিন শাহ আরও জানাচ্ছেন, "আমাকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল গুজরাটে পৌঁছানোর পর বাহিনীকে গাড়ি, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ এসকর্ট, কমিউনিকেশন সিস্টেম আর শহরের নকশা দেওয়া হবে। কিন্তু পৌঁছে দেখলাম ওসব কিছুই নেই।" এতে কি প্রমাণিত হয় না, নরেন্দ্র মোদী মূলতই একটা হীন উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতিতে এসেছেন। যা মহাত্মা গান্ধীর ভারতকে আজ কলংকিত করে তুলেছে বিশ্বব্যাপি। বাংলাদেশ এই বছরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালন করছে। এই অনুষ্ঠানমালায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। তিনি আসছেন পদাধিকার বলে। কেউ কেউ মোদী'কে 'না'- বলে ক্যাম্পেন করতে চাইছেন। আমি এটার যুক্তি আছে বলে মনে করি না। কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও অনেক অপকর্ম করছেন। তিনিও নিজের দেশে খুবই বিতর্কিত। কিন্তু বিশ্বের কাছে তিনি মার্কিন মুলুকের প্রেসিডেন্ট। একই কথা মোদী'র বেলায়ও প্রযোজ্য। মোদী বাংলাদেশের অনুষ্ঠানমালায় আসতেই পারেন। তার অপকর্মের জবাবদিহিতা তাকে করতে হবে অন্য প্লাটফর্মে। মুজিব জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে নয়। ভারতের রাজনীতিকরা সচেতন।

কংগ্রেস ক্যাম্পেন চালিয়েই যাচ্ছে। নেতারা কথা বলছেন। তাই সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেসকে রুখে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিতে হবে। ভারতের দাঙ্গা নিয়ে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মৃতের সংখ্যা ( এই লেখা পর্যন্ত) ৩৮ ছাড়িয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, নিবিড়ভাবে দিল্লি পরিস্থিতি নজরে রাখছে জাতিসংঘ। বিক্ষোভকারীদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করতে দেয়া এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সংযত থাকা উচিত- এ বিষয়টির ওপরই গুতেরেস জোর দিচ্ছেন।সেইসঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব শান্ত পরিবেশ এবং স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা জরুরি বলেও গুতেরেস মত দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে করতে চাইছেন তার আরও একটি প্রমাণ দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরলিধরকে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলি করা হয়েছে। দিল্লিতে কয়েক দিন ধরে চলা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায়, কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের পাশাপাশি দিল্লি পুলিশের কড়া সমালোচনা করেছিলেন বিচারপতি এস মুরলিধর। বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ঘিরে রাজধানী দিল্লিতে দিন কয়েক ধরে চলা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যখন চরমে। আহত দুই শতাধিক। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই রয়েছেন। নিহত হয়েছেন পুলিশ কর্মী, গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যও। দিল্লি হাইকোর্টে এক শুনানিতে বিচারপতি এস মুরলিধর বলেছিলেন, ‘আমরা ১৯৮৪ সালের মতো আরেকটি ঘটনা দেশে ঘটতে দিতে পারি না।’ভারতবাসী শান্তি চান। শান্তি চান, বিশ্বের মানুষ। তাই এই বিষয়ে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। কারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো মারত্মক দাঙ্গা আর কিছু নেই। যে দাগ মানুষের মননে থেকে যায় জনম,জনম-যুগের পর যুগ। নিউইয়র্ক/ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

এইচআর/জেআইএম