আন্তর্জাতিক

ক্ষুধাপীড়িত লেবাননের অবস্থা ‘যুদ্ধের চেয়ে ভয়ঙ্কর’

দুই সন্তানের মা সুজান, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। থাকেন লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরতলীর একটি ছোট্ট ঘরে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সৃষ্টি হওয়া সাম্প্রতিক দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে যেন দুঃখের সঙ্গে ক্ষোভও বেরিয়ে এলো তার কণ্ঠে। বললেন, ‘এমন অন্ধকার সময় আগে কোনোদিন দেখিনি। এ অবস্থা যুদ্ধের চেয়ে ভয়ঙ্কর।’

লেবানিজদের জন্য সময়টা মোটেও ভালো যাচ্ছে না। গত ছয় মাসের দুর্দশা যেন ছাড়িয়ে গেছে ১৯৯০ সালে শেষ হওয়া ১৫ বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধকেও। যুদ্ধনেতা থেকে হয়ে ওঠা রাজনৈতিক নেতাদের কয়েক দশকের দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, অভিজাত ব্যবসায়ীদের চক্রান্ত, তার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী সিরিয়ার যুদ্ধ লেবাননের অর্থনীতিকে টেনে নামিয়ে স্মরণকালের সবচেয়ে গভীর সংকটে।

এতদিনের দুঃসময়ের সঙ্গে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস মহামারি। এমন সংকটে সুজানের মতো অনেকেই জীবনে প্রথমবার সাহায্যের জন্য হাত পাততে বাধ্য হচ্ছেন। সময় যত যাচ্ছে, দেশটির পরিস্থিতি যেন ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। মানুষের ক্ষুধার জ্বালার সঙ্গে বাড়ছে ক্ষোভও।

সংকট থেকে বিপর্যয়ে অর্থনীতিআন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে, চলতি বছর লেবাননের অর্থনীতি অন্তত ১২ শতাংশ সংকুচিত হয়ে পড়বে, যা মধ্যপ্রাচ্যের চেয়েও অনেক বড় বিপর্যয় এবং ভেনেজুয়েলা-চাদের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক মন্দা হবে।

তবে এই অবস্থা হঠাৎ করেই আসেনি। কয়েক দশক আগে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক পতন গত বছর বিশাল ধসে পরিণত হয়েছে মাত্র। তাদের মুদ্রার মান নামতে নামতে গিয়ে পড়েছে একেবারে তলানিতে। এখন ১৫শ’ লেবানিজ পাউন্ড দাঁড়িয়েছে এক ডলারের সমান।

এমন জরাজীর্ণ অর্থনীতির কারণে লেবাননে গত অক্টোবরে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছিল। সেসময় হাজার হাজার মানুষ দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংস্কার ও গৃহযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন।

গত বছর অর্থনৈতিক পতনের পরপরই অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, নাহয় তাদের বেতন অর্ধেক করে দেয়া হয়েছে। আর যারা চাকরিতে বহাল আছেন, মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় তাদের বেতনও কার্যত অর্ধেক হয়ে গেছে। সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো ডলার দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি স্থানীয় মুদ্রা লেনদেনেও সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে।

এমন বিপর্যয়ের মধ্যে সম্প্রতি যোগ হয়েছে করোনাভাইরাস সংকট। এ মহামারির কারণে রাতভর কারফিউ, মাসব্যাপী লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ জারি করেছে লেবানন সরকার। এর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে।

‘ফাঁদ পাতা’ তালিকাসপ্তাহ তিনেক আগে লেবাননের সদ্যগঠিত সরকার ১ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ পরিবারকে ১৩০ ডলার করে অর্থসহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেয়। এই অর্থ দিয়ে একেকটি পরিবার কোনোমতে দুই-তিনমাস চলতে পারবে। তবে এতদিন হয়ে গেলেও এখনও সেই অর্থ বিতরণ করা হয়নি। এর জন্য রাজনীতিকে দায়ী করছে দেশটির সরকার।

বিশ্ব ব্যাংক অনুমোদিত একটি জাতীয় দারিদ্র্য লক্ষ্যমাত্রা কর্মসূচিতে নগদ অর্থসহায়তার জন্য দেড় লাখ অতিদরিদ্র পরিবারের নাম নিবন্ধিত করার কথা ছিল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব জানিয়েছেন, রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অভিপ্রায়ের কারণে ওই তালিকাটি সরকারের জন্য একটি ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত দরিদ্রদের বদলে রাজনৈতিক যোগসাজশ ও বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে ত্রুটিপূর্ণ তালিকা তৈরি হয়েছে। এর ফলে ডাটাবেজে নাম ওঠা প্রায় এক লাখ পরিবার কোনো ধরনের অর্থসহায়তা পাবে না।

লকডাউন অমান্যের প্রবণতাসরকার একদিকে প্রকৃত দরিদ্রদের সহায়তা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, অন্যদিকে এমন মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। লেবাননের জনসংখ্যা বর্তমানে ৬০ লাখের মতো। এর মধ্যে ১৫ লাখই সিরিয়া ও ফিলিস্তিনি শরণার্থী।

চলতি সপ্তাহে লেবাননের সমাজ বিষয়ক মন্ত্রী রামজি মৌচারাফিহ জানিয়েছেন, দেশটির অন্তত ৭৫ শতাংশ মানুষেরই এখন সহযোগিতা প্রয়োজন।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য না পেয়ে বেশির ভাগ মানুষই এখন বিভিন্ন দাতা সংস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, নাহয় ভিক্ষাবৃত্তিতে ঝুঁকছে।

পরিস্থিতি দিন দিন যতই খারাপ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে আইনভঙ্গের প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই ঘরে থাকার নির্দেশনা অমান্য করে খাবারের সন্ধানে বের হতে বাধ্য হচ্ছেন। ইতোমধ্যেই কারফিউ ও সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনা অমান্য করে বৃহস্পতি-শুক্রবার বৈরুত, সিডন, ত্রিপোলি ও অ্যালে শহরে বিক্ষোভ হয়েছে।

গতবছর যেখানে লেবাননের মানুষজন স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ঐক্যের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিল, আজ তাদের আন্দোলনের সুর বদলে গেছে। এখন তাদের লড়াই চলছে খাবারের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য, পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য।

সূত্র: আল জাজিরা

কেএএ/পিআর