মতামত

দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর

এখন গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় নেই, কিন্তু আমি গ্রামের ছেলে। আমি যেখানে জন্মেছি, দাউদকান্দির রঘুনাথপুরে আমার নানাবাড়ি, তখন নিঝুম পাড়া-গাঁ ছিল। এখন সেখানে গাড়ি যায়, কিন্তু তখন সেখানে বর্ষায় নৌকা ছাড়া আর কোনো যোগাযোগের উপায় ছিল না। আমার যেখানে বেড়ে ওঠা, চাঁদগাঁওয়ের দাদাবাড়ি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে হলেও আমাদের ছেলেবেলায় সেটিও যথেষ্ট গ্রাম ছিল।

আমাদের একটি কলাবাগান, একটি সুপারিবাগান আর একটি বাঁশবাগান ছিল; সাথে ছিল আম, পেঁয়ারা, নারিকেল, জাম্বুরা, আতা, ডালিম, কদবেল, তাল, খেজুর, গাব, লিচুসহ নানান ফল গাছ। আর ছিল বেলি, গন্ধরাজ, হাসনাহেনাসহ নানান ফুলের গাছ।

আমি একদম গ্রামের ছেলে। বড়শি বা জাল দিয়ে মাছ ধরা, ছাগল-মুরগি পালা, বৃষ্টিতে ফুটবল খেলা, তাল-নারিকেল-সুপারি গাছে চড়া, নৌকা বাওয়া, দিনভর পুকুরে দাপাদাপি করা, উঁচু সেতু থেকে খরস্রোতা নদীতে লাফ দেয়া, ঝড়ের রাতে আম কুড়ানো, টিনের চালে বৃষ্টির গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাওয়া- অমূল্য সব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ আমার ছেলেবেলা। এসএসসি পাসের পর উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথমে কুমিল্লা, পরে ঢাকার ফাঁদে আটকে গেছি। কিন্তু তবুও আমি গ্রামেরই ছেলে।

অনেকে দেশের বাইরে সেকেন্ড হোম বানায়, কানাডা-অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্রেশনের জন্য প্রাণপাত করে। আমার স্বপ্ন হলো শেষ জীবনটা গ্রামে কাটানো। কিন্তু সমস্যা হলো আমি যে গ্রামে ফিরতে চাই, সে গ্রাম আর পাই না। আমার দাদাবাড়ি তো বটেই, নানাবাড়িতেও এখন গাড়ি যায়। আমি চাই এমন একটা গ্রাম যেখানে গাড়ির হর্ন শোনা যাবে না। তেমন গ্রাম কি বাংলাদেশে আছে আর?

বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যহীন রাষ্ট্র। সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক। ব্যবসা বলুন, চাকরি বলুন, পড়াশোনা, চিকিৎসা সব ঢাকাকেন্দ্রিক। নদীভাঙনকবলিত মানুষ ছুটে আসে ঢাকায়, ঝড়ে নিঃস্ব হলেও ঢাকা। মানুষের ভারে ঢাকার প্রায় ভেঙে পড়ার দশা। আসলে ঢাকা সবার, আবার ঢাকা কারোরই নয়। দুই ঈদ এলেই ঢাকা ফাঁকা হয়ে যায়।

জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার মাত্র ১৯ ভাগ মানুষের নিজের থাকার জায়গা আছে। বাকি ৮১ ভাগই ভাড়াটে। তাদের ঢাকায় কোনো শিকড় নেই। আমিও সেই ৮১ ভাগের দলে। গত ৩২ বছরে এই ঢাকায় অন্তত ১৫ বার ঠিকানা বদল করেছি। যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুর, মোহাম্মদপুর থেকে রাজাবাজার- কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়িয়েছি। ব্যাচেলর থাকতে সমস্যা ছিল একরকম, এখন অন্যরকম।

আমার ৩২ বছরের অভিজ্ঞতা হলো, ঢাকায় ব্যাচেলর হওয়া পাপ আর ভাড়াটে হওয়া অপরাধ। এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না, বাড়িওয়ালার যেন ঈশ্বরের মতো ক্ষমতাধর। ৩২ বছরে একাধিক ফ্ল্যাটের দাম বাড়িওয়ালাদের দিয়েছি, কিন্তু কোনো ঠিকানা হয়নি।

করোনা এসে সব ওলটপালট করে দিয়েছে। মানুষের ঢাকামুখী স্রোতে এখন উল্টো টান। করোনার থাবায় হঠাৎ জীবিকা হারানো মানুষ এখন দিশেহারা। যখন তারা বুঝে গেছেন, অর্থনীতিতে করোনার থাবার যে ক্ষত; তা সহজে শুকাবে না; তখনই তারা তল্পিতল্পা ট্রাকে তুলে বাড়ির পথ ধরছেন। এমনকি ৩০/৩৫ বছর ঢাকায় থাকার পরও চলে যেতে হচ্ছে এক ট্রাকে।

ঢাকা আসলে সবার, কিন্তু ঢাকা কারো নয়। ঢাকা একটি নিষ্ঠুর শহর। ৮১ ভাগ মানুষই এই শহরকে অন্তরে ধারণ করে না। আমার মতো তারা বছরের পর বছর থাকে, কিন্তু হৃদয়ে সেই গ্রামের জন্য ভালোবাসা, নাড়ির টান। এক জরিপে দেখা গেছে, সুযোগ-সুবিধা পেলে ৫৩ ভাগ মানুষই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাবেন।

ট্রাকভর্তি মাল নিয়ে কাউকে ঢাকা ছাড়তে দেখলে আমার কেন জানি ২৮ বছর আগের একটা স্মৃতি মনে পড়ে। বছর পাঁচেক মেসে মেসে কাটানোর পর ৯২ সালে ঢাকায় আমাদের প্রথম বাসা হয়। তখন আমার অফিস গ্রিন রোডে, বাংলাবাজার পত্রিকা। বাসা নিয়েছি পূর্ব রাজাবাজারে। এমনই একটি ট্রাকে মালামাল নিয়ে আব্বা, আম্মা, ভাইবোন সবাই ঢাকা এসেছিল। পূর্ব রাজাবাজার মসজিদের সামনের খালি জায়গায় ট্রাক রেখে মালামাল নামানো হয়েছিল। তারপর আমাদের আর গ্রামে ফেরা হয়নি। কালেভদ্রে গেলেও রাতে থাকার ব্যবস্থা নেই। অথচ সেখানেই আমার শৈশব, কৈশোর।

এখন যারা ঢাকা ছাড়ছেন, তাদের ঢাকা ছাড়ার ট্রাক দেখে আমার ২৮ বছর আগের সেই ট্রাকটির কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয়, আমিও তো সেই ৮১ ভাগের মতো একজন, যার ঢাকায় থাকার জায়গা নেই; আমি তো নেই ৫৩ ভাগের একজন, যারা ঢাকা ছাড়তে চান। কিন্তু এখন যারা যাচ্ছেন, তারা কিন্তু মনের আনন্দে যাচ্ছেন না; বাধ্য হয়ে বাঁচার তাগিদে যাচ্ছেন। তাদের দেখে আমার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। একবার মনে হয়, ইশ আমিও যদি তাদের মতো গ্রামে চলে যেতে পারতাম। আবার ৪০ বছরের সংসার এক ট্রাকে তুলে চোখের জলে কাউকে ঢাকা ছাড়তে দেখলে মনটা খারাপও হয়।

তবে করোনা কিন্তু আমাদের সামনে একটা ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্র গড়ার সুযোগ দিয়েছে। জীবিকার খোঁজে ঢাকা আসার চেয়ে এখন বাঁচার তাগিদে ঢাকা ছাড়ার হিড়িক। গত দুই মাসে নাকি ৫০ হাজার পরিবার ঢাকা ছেড়েছে। এখন গ্রামীণ অর্থনীতি যদি এই ৫০ হাজার পরিবারকে ধারণ করতে পারে, শহর থেকে যাওয়া মানুষগুলো যদি গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি আনতে পারে; তাহলে সবারই লাভ।

অল্পকিছু টাকার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ফুটমাপা বাসায় বন্দী থাকার চেয়ে গ্রামে নিজের বাড়ি থাকা এবং নিজের ফলানো সবজি খাওয়ার আনন্দ অবশ্যই বেশি। আর শহর থেকে যাওয়াদের মধ্যে যারা একটু উদ্যমী, তারা কিন্তু দ্রুতই নিজের জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে মাছ, মুরগি, হাঁস-চাষ; ফল-সবজি লাগিয়ে ধীরে ধীরে বদলে ফেলতে পারেন নিজের নিয়তি।

গ্রামগঞ্জে এখন ইন্টারনেট, তাই আপনি কী করছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ; কোথায় আছেন, সেটা কেউ জানতেও চাইবে না। শিক্ষা, চিকিৎসা সুবিধা গ্রামে ছড়িয়ে দিতে হবে; যাতে বিপদে পড়ে গ্রামে যাওয়া কেউ আর ঢাকায় ফিরতে না চান।

আমার কাছে দেশপ্রেম মানে নিজের কাজটা সবচেয়ে ভালোভাবে করা। গত ৫০ বছরে বাংলার কৃষকরাই তাদের কাজটা সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পেরেছেন। আর পেরেছেন বলেই আমরা এখন বড় বড় কথা বলতে পারছি, বড় বড় কলাম লিখতে পারতাম না।

করোনা যতই ক্ষতি করুক, আমাদের না খাইয়ে মারতে পারবে না, দুর্ভিক্ষের কোনো শঙ্কা। শহর থেকে যাওয়া মানুষগুলো আন্তরিকতা নিয়ে কৃষকদের পাশে দাঁড়ায়, মাঠের কৃষকের সাথে ঢাকার আড়তের যোগাযোগ করিয়ে দেন; তাহলে তো সবাই ভালো থাকতে পারেন।

সেই অরণ্য আর ফিরে পাবো কিনা জানি না, লও তোমাদের ঢাকা নিয়ে তোমরাই থাকো।

৬ জুন, ২০২০

এইচআর/বিএ/পিআর