প্রবাস

স্মরণে কবি কাজী নজরুল ইসলাম

এক হাতে তার অগ্নিবীণা, অন্যহাতে বিষের বাঁশি। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এক মহান পুরুষ যার কলমের প্রতিটি লাইন যেনও মহান সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা। কণ্ঠে তার এক সুর-

‘আমি সেই দিন হব শান্ত,যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্তআমি সেই দিন হব শান্ত’

তিনি আর কেউই নন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যিনি একই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবেও পরিচিত। বাংলাভাষী মানুষের কাছে তিনি যেনও এক বিদ্রোহের প্রতীকরূপে সমাদৃত। তবে সে বিদ্রোহ নিতান্তভাবে অন্য সকল বিদ্রোহ থেকে প্রকৃতিগত দিক আলাদা। এ বিদ্রোহের পেছনে নেই কোনো অভিলক্ষ্য।

কেবলমাত্র নিপীড়িত মানুষের উদ্দেশ্যে ধ্বনিত হয়েছে এ বিদ্রোহ। সুকান্ত ভট্টাচার্য কিংবা রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও বিদ্রোহের কবিতা রচনা করেছেন তবে তাদের প্রত্যেকের বিদ্রোহ ছিল মার্কসবাদী চিন্তাধারার নিরিখে প্রতিফলিত, এদিক থেকে নজরুল ছিলেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং তার বিদ্রোহী চেতনাকে কোনো ধরনের রাজনৈতিক আদর্শ দিয়ে কখনও ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

সমাজের সকল বৈষম্যের মূলে তিনি লিখে গেছেন দুই চরণের মাধ্যমে:-

‘গাহি সাম্যের গান-যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান’!

বাংলা সাহিত্যে নজরুল হচ্ছেন এমন একজন কবি যাকে আপনি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারেন। একদিকে তিনি যেমন তার সাহিত্যচর্চায় ইসলামী মূল্যবোধ ও ভাবধারাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন, অন্যদিকে শ্যামা সঙ্গীত চর্চায়ও তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। আবার ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললে কেউই লেখনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সেভাবে প্রস্ফুটিত করতে পারেননি কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে রকমভাবে করেছেন। বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে তাই যখন হিন্দু এবং মুসলমান এ দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে অসহিষ্ণুতা রীতিমতো যখন এক বিপর্যয়ের রূপ নিলো সে সময়ে তিনি লিখেছেন-

‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।এক সে আকাশ মায়ের কোলেযেন রবি শশী দোলে,এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,এক সে মায়ের বক্ষে ফলাই একই ফুল ও ফল।এক সে দেশের মাটিতে পাইকেউ গোরে কেউ শ্মাশানে ঠাঁইএক ভাষাতে মাকে ডাকি, এক সুরে গাই গান’।

এমনকি সে যুগেও তিনি তার সন্তানদের নাম রেখেছিলেন কাজী সব্যসাচী, কৃষ্ণ মুহাম্মদ, কাজী অনিরুদ্ধ এবং অরিন্দম খালেদ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি অথচ বাংলা সাহিত্যকে তিনি করেছেন সমৃদ্ধ। ৪২ বছর বয়সে তিনি মস্তিষ্কের এক দুরারোগ্য ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হন, তার সাহিত্যচর্চায় ছেদ পড়ে এবং তিনি ধীরে ধীরে তার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন।

সত্যি বলতে তার সাহিত্যচর্চার সময় ছিল বিশ থেকে চব্বিশ বছরের মতো যেটা নিতান্ত কম বলতে হবে। তবুও এ স্বল্প সময়ে তিনি তার লেখনীর দ্বারা গোটা বাঙালির হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন। আর এ কারণে বিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সময় বাংলা সাহিত্যের মধ্যগগণে পদচারণা করছেন, ঠিক সে সময় নজরুলের আবির্ভাবকে অনেকে ধূমকেতুর সাথে তুলনা করেছেন।

নজরুলের আরও একটি কৃতিত্ব হচ্ছে বিশ্বের কোনও কবি কিংবা গীতিকার এককভাবে একসাথে এতবেশি সঙ্গীতের রচনা করতে পারেননি যেটা নজরুল পেরেছেন। আরবি, ফার্সি, সংস্কৃতসহ বিভিন্ন ভাষার শব্দমালার সংমিশ্রণে তিনি নতুন নতুন অনেক সুরের সৃষ্টি করেছেন। আবার প্রেমিক কবি হিসেবেও নজরুল ঠাঁই করে নিয়েছেন কোটি কোটি যুগলের হৃদয়ে। তার রচিত একটি বিখ্যাত প্রেমের কবিতা-

‘তোমারে পড়িছে মনেআজি নীপ-বালিকার ভীরু-শিহরণে,যুথিকার অশ্রুসিক্ত ছলছল মুখেকেতকী-বধূর অবগুণ্ঠিত ও বুকে-তোমারে পড়িছে মনে।হয়তো তেমনি আজি দূর বাতায়নেঝিলিমিলি-তলেম্লান লুলিত অঞ্চলেচাহিয়া বসিয়া আছ একা,বারে বারে মুছে যায় আঁখি-জল-লেখা।বারে বারে নিভে যায় শিয়রেরে বাতি,তুমি জাগ, জাগে সাথে বর্ষার রাতি।’

বস্তুতপক্ষে বাংলা সাহিত্যে নজরুলের তুলনা নেই, তিনি নিজেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী। এমনকি নিখিল ভারতে স্বাধীনতাকামী মানুষের মাঝে প্রথম স্বাধীনতার বীজ বোপিত হয়েছিলো তার মাধ্যমে এমনটি দাবি করলেও ভুল হবে না। সত্যি কথা বলতে গেলে ১৯২০ সালের ১২ জুলাই নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে।

অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ওই বছরই এই পত্রিকায় ‘মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়। নজরুল ব্রিটিশ সরকারের জনরোষে পতিত হন এবং রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতাকামী মানুষের উদ্দেশ্যে তার লেখা-

‘কারার ওই লৌহকপাট,ভেঙে ফেল, কররে লোপাট,রক্ত-জমাটশিকল পূজার পাষাণ-বেদী।ওরে ও তরুণ ঈশান!বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!ধ্বংস নিশানউড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি’।

আজ ২৭ শে আগস্ট, ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারের পাড়ি জমান। মৃত্যবার্ষিকীর এই দিনে তাই নজরুলের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। ভারত যদি দাবি করে যে মহাত্মা গান্ধী কিংবা কংগ্রেসের কারণে এ উপমহাদেশের মানুষ ব্রিটিশ শাসনের যাতাকল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল এবং পাকিস্তান যদি দাবি করে থাকে যে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের কারণে তারা ভারত থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন আবাসভূমির স্বাদ লাভ করতে পেরেছিল তবে তাদের সকলের এ দাবি বাস্তবে রূপ নেওয়ার পেছনে নিভৃত কারিগর ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম যিনি সব সময় থেকে গিয়েছেন পর্দার অন্তরালে।

এমআরএম/পিআর