কাজী শাহাদাত
সুন্দরবন ঘোরা অন্যসব ভ্রমণের মতো সাধারণ কিছু নয়। এতে আছে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যময় কিছু ঘটনা। এই বিশাল বনের এক স্পট থেকে আরেক স্পটে যেতে সময় লাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অবস্থান করতে হয় জাহাজে, ঘুমাতে হয় লঞ্চের কেবিনে।
স্পট ভিজিট করার জন্য বড় নদীতে জাহাজ নোঙর করে উঠতে হয় যন্ত্রচালিত ছোট নৌযান তথা ট্রলারে। তারপর নদী পাড়ি দিয়ে ঢুকতে হয় বনের ভেতরকার ছোট নদী বা খালে। পল্টুনে ট্রলার ভিড়িয়ে গাইডের নির্দেশনা মেনে সশস্ত্র বনপ্রহরী সঙ্গে নিয়ে দর্শনে বেরুতে হয়।
বনের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ যেমন আছে, তেমনি প্রতি মুহূর্তে বাঘের ভয় আছে। পর্যটকরা আনন্দ উচ্ছলতায় মুক্ত মনে ঘুরে বেড়ায়, আর হিংস্র বাঘ সন্তর্পণে শিকারীর সন্ধানে চালায় সতর্ক তৎপরতা।
সুন্দরবন ভ্রমণের প্রথম দিন সোমবারের শেষ স্পট দুবলার চর থেকে চাঁদপুর প্রেস ক্লাব ভ্রমণ দলকে বহনকারী দুটি জাহাজ পরবর্তী স্পট কটকার উদ্দেশ্যে রওনা করে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে। আর সেখানে পৌছায় রাত পৌনে ২টায়। সবাই সন্ধ্যার নাস্তা ও রাতের খাবার সেরে ১০টার মধ্যে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়।
সুখনিদ্রায় কাটলো রাতটি। সুন্দরবনের গাছের চূড়া ভেদ করে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখার সুযোগ হলো অনেকেরই। ভালোই শীত অনুভূত হচ্ছিল। নির্মেঘ আকাশে সূর্য যতই ওপরে উঠছিল তাপমাত্রা ততই বাড়ছিল। ৯টার পর কটকার প্রথম ভ্রমণ সাইট জামতলা বন-এলাকা ও সমুদ্র সৈকতের দিকে রওনা দিলো ভ্রমণ দলটি।
পল্টুনে গিয়ে ‘বনবিলাস’ ও ‘অবসর’ নামক দুটি জাহাজের লোকজন একদিন পর একত্রিত হয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে গিয়ে হৈচৈ করে ওঠে। গাইড চুপ থাকার অনুরোধ জানিয়ে কিছু পথনির্দেশ দিলেন।
বললেন, বনের ভেতর প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে আপনারা যাবেন জামতলা বিচে। সাবধান, কোনোভাবেই দলছুট হবেন না। ছবি তুলতে চাইলে বলবেন, গাইড কিংবা গার্ড থামবে, ছবি তোলা শেষ হলে আবার দলবদ্ধভাবে চলবেন।
কোনোভাবেই দলবিচ্ছিন্ন হয়ে একাকি চলতে যাবেন না। বাঘ মামা সুযোগ পেলেই হামলে পড়বে। দু’পাশে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে চলার চেষ্টা করবেন। কিং কোবরা (অজগর) তেড়ে না আসলেও বাঘ কিন্তু তেড়ে আসতে পারে।
গাইডের কথা শুনে ভ্রমণ দলের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত বিভাজন তৈরি হলো। পায়ে হাঁটার কষ্ট ও বাঘের ভয়ে দশের অধিক সদস্য থেকে যেতে চাইল। তারা পৃথক গাইডের তত্ত্বাবধানে সুন্দরবনের অভ্যন্তরস্থ ক্যানেল তথা খালে ভ্রমণ করতে গেল, আর দলের অন্য সকলে কটকার জামতলা এলাকার বন ভেদ করে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে সাগর সৈকতের দিকে সাহস ভরে পা বাড়ালো।
পথিমধ্যে বন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করতে মনে ভয় জাগলো বেশি। কারণ, এই বনেই বাঘের মুখোমুখি হবার অভিজ্ঞতা তার দু’বারেরও বেশি আছে। একবার তিনি বাঘ দেখে এক রাউন্ড গুলি ছুড়লেন। তাতে বাঘটি উল্টো তার দিকে তেড়ে আসছিল দেখে তিনি আরো তিন রাউন্ড গুলি ছুড়লেন।
তারপর সেটি লাফ দিয়ে পালায়। তিনি বললেন, কাছ থেকে নিরাপদে বাঘ দেখতে হলে চিড়িয়াখানা বা সাফারি পার্কে দেখাই উত্তম। কেননা সৌন্দর্য, দৈর্ঘ্যসহ আঙ্গিক সৌষ্ঠবে সুন্দরবনের বাঘ যেমন বিখ্যাত, তেমনি হিংস্রতা-ক্ষিপ্রতায় জগদ্বিখ্যাত। এর তেজি-হিংস্রভাব স্বচক্ষে দেখে নিজেকে ঠিক রাখা নিরানব্বই ভাগ লোকের পক্ষেই সম্ভব হয় না।
তিনি জানান, ক’বছর আগে ৭০০ পর্যটক দলের নিরাপত্তায় আমিসহ বনবিভাগের ২০ জন ছিলাম। আজকে আপনারা যে জামতলা এলাকার বন পেরুচ্ছেন তার মধ্যেই (আঙ্গুল দিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে) উঁকিমারা অবস্থায় একটি বাঘ দেখে আমি ‘বাঘ’ বলে চিৎকার দিলাম।
আমি পরপর চার রাউন্ড গুলি ছুড়ে বাঘ তাড়ালাম। বাঘ পালিয়ে যাবার পর আমার সামনে পেছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। পর্যটকরাতো পালিয়েছেই, এমনকি আমার সঙ্গীয় নিরাপত্তা প্রহরীরা দূরবর্তী নিরাপদ স্থানে গিয়ে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে দেখতে পাই।
আসলে ক্ষুধার্ত বাঘ কিছুতেই ভয় পায় না। পুরুষ বাঘ তো ক্ষুধার্ত হয়ে শিকার খুঁজে না পেলে নিজের বাচ্চাকেই খেয়ে ফেলে।
চলবে...
লেখক, প্রধান সম্পাদক দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ
এমআরএম/এএসএম