বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্যাঁচা নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে। আছে কিছু গুজবও। তারা মনে করেন, লক্ষ্মীপ্যাঁচার ডাক অশুভ কিছুর বাহক। রাতে যে বাড়ির পাশে এ প্যাঁচা ডাকে, সে বাড়িতে হাজির হয় মৃত্যুদূত। কয়েক দিনের মধ্যেই ওই বাড়িতে মৃত্যু হয় কারও কিংবা ঘটে দুর্ঘটনা।
আবার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের বিশ্বাস মতে, লক্ষ্মীর বাহক এই প্যাঁচার নাম দিয়েছে লক্ষ্মীপ্যাঁচা। তাদের কাছে এ পাখি পূজনীয়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে, প্যাঁচা শুভ কিংবা অশুভ কোনোটিই নয়। অন্যান্য প্রাণীর মতো তারাও প্রাণী জগতের সদস্য।
প্রাচীনকাল থেকে পাখিদের মধ্যে প্যাঁচা নিয়েই বেশি কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। তার একটি হলো- অন্ধকার রাতে প্যাঁচার মুখোমুখি হলে গায়ে থুথু ছিটাতে হয়। আবার কোনো এলাকায় অশুভ বাতাস ছাড়াতে লোহাজাতীয় কোনো বস্তু চুলোয় দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়া হয় গায়ে। কোনো কোনো জায়গায় অশুভ মনে করে পুড়িয়ে মারা হয় প্যাঁচা। কিছু ধর্মে ভাগ্য উন্নয়নের আশায় ‘প্যাঁচাবলি’ দিয়ে প্যাঁচার দেহের বিভিন্ন অংশ তাবিজে করে গলায় পরানো হয় ব্যক্তির।
উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া ও এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নালসহ কয়েকটি প্রবন্ধে প্যাঁচার জীবনচক্র ও এই প্রাণীর বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়।
বিশ্বজুড়ে শতাধিক প্রজাতির প্যাঁচার দেখা মিললেও বাংলাদেশে দেখা পাওয়া যায় ১০-১৫ প্রজাতির প্যাঁচা। এর মধ্যে হুতুম, লক্ষ্মী, নিমখোর, ভুতুম, রূপালি, পিশাচ, জমদূত, গুহা, হিমহিম, বানরমুখো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
উইকিপিডিয়া বলছে, প্যাঁচার ঠোঁটের রঙ মাংসল সাদা, পা ও আঙুল মাংসল। শরীরের তুলনায় মুখমণ্ডল অনেকাংশেই বড় হয়ে থাকে। প্যাঁচার মাথা বড়, মুখমণ্ডল চ্যাপ্টা এবং মাথার সম্মুখদিকে চোখ থাকে। অন্যান্য শিকারি পাখি ঈগল ও বাজের ন্যায় এর লম্বা, শক্তিশালী পায়ের থাবার সঙ্গে তীক্ষ্ণ নখ রয়েছে।
উইকিপিডিয়া আরও বলছে, নিশাচর ও শিকারি পাখি হিসেবে প্যাঁচা গোধূলীলগ্নে সক্রিয় হয়ে উঠে। মাঝে মাঝে দিনের বেলায়ও এদের দেখা মেলে। সাধারণত বনভূমিতে এদের দেখা যায়। শিকার নিয়ে কোনো কাঠ বা খুঁটির উপরিভাগে বসতে পছন্দ করে এরা। খুবই নিঃশব্দে এরা পথ চলতে পারে এবং এদের শ্রবণশক্তি খুবই তীক্ষ্ণ। শুধু শব্দ দ্বারা চালিত হয়ে এরা নিরেট অন্ধকারে শিকার ধরতে পারে। সামান্য মাথা ঘোরালে প্যাঁচা অনুচ্চ শব্দ যেমন- ইঁদুরের শস্যদানা চিবানোর আওয়াজও শুনতে পায়। এর কারণ হচ্ছে মাথার গড়ন রূপান্তরিত হওয়ার জন্য প্যাঁচার দুই কানে সামান্য আগে পরে শব্দ পৌঁছায়।
এক গবেষণায় প্যাঁচার ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দেখা গেছে, আকৃতিতে পুরুষ প্যাঁচার চেয়ে নারী প্যাঁচা একটু বড় হয়। গাছের কোটরে এদের বসবাস। আবার উঁচু মগডাল কিংবা পরিত্যক্ত বাড়িও প্যাঁচা পছন্দ করে থাকে। এরা দুই কানে দুই রকম শব্দতরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে। দিনের উজ্জ্বল আলো সহ্য করতে পারে না বিধায় প্যাঁচা খুব ভোর ও ঘন সন্ধ্যায় শিকারে বের হয়।
আবার অর্থনীতিতে প্যাঁচা অনেক উপকারী ভূমিকা পালন করে। তারা ফসলের প্রধান শত্রু ইঁদুর খেয়ে ফসলকে রক্ষা করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্যাঁচা পরিবেশবান্ধব একটি প্রাণী। প্যাঁচা ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত শুভ-অশুভ কোনো বিশ্বাসই সঠিক নয়। প্রাণিজগতের সবকিছুই বাস্তুতাত্ত্বিক ভারসাম্য প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের মুসলিম ধর্ম মতে, আল্লাহ সবকিছু মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছেন। বাংলাদেশে প্যাঁচা বিপন্ন প্রাণী নয়; তবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন দ্বারা সংরক্ষিত। তবে আমাদের অবহেলা হলে এটিও বিপন্ন প্রাণির তালিকায় পড়ে যাবে। শুধু প্যাঁচা নয় সব প্রাণীকে মানুষের প্রয়োজনেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্যাঁচার অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ফসলি ক্ষেতে এক ধরনের ডাল পুতে দেয়া হয় যাতে বিভিন্ন পাখি বসে ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফেলতে পারে। এই ডালে বসেই রাত্রে পেঁচা ফসলের জন্য ক্ষতিকর ইঁদুর খেয়ে ফেলে। এই কারণে অনেক টাকার ফসল রক্ষা পায়। আবার ফসল পরিপক্ব হলে ক্ষেতের মাঝখানে কাকতাড়ুয়া বসানো হয় যাতে পাখি বসে আবার ফসল খেতে না পারে।’
এআরএ/জেআইএম