মতামত

‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও’

ড.মাহবুব হাসান

ঢাকা মহানগরের নামের সাথে ‘ভোগান্তি’ আজ ওতপ্রোত। কোন সেক্টরে নেই ভোগান্তি? আপনি বাসা থেকে বেরোলেই দেখতে পাবেন নগরে-মহানগরে বাস করার অনুপযুক্ত মানুষের ভিড়। নগরে বসবাস করতে হলে কিছু বিষয় বসবাসকারীদের জানা ও মেনে চলা খুব জরুরি হলেও তারা সে ব্যাপারে সজাগ নয়, মনে হয় যেন উৎসাহীও নয়। কারণ তাদেরকে নগরে বাস করার রীতিনীতি, শৃঙ্খলা ও কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা/প্রশিক্ষণ দেয়া না নগর কর্তৃপক্ষ। নগর কর্তৃপক্ষের স্থানীয় প্রতিনিধিরা প্রতি পাড়ায়-মহল্লায় এ-সংক্রান্ত কাজ সরেজমিনে দেখাতে পারেন ও শিক্ষার ব্যাপারে লোক নিয়োগ করতে পারেন, তাহলে এ-সমস্যার সমাধান হতে পারে। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও’।

আমি ৫০ বছর আগে এই মহানগরের বাসিন্দা হয়েছি। তখন এতো ঘন-বসতি না থাকলেও নাগরিকদের মধ্যে বসবাসের রীতিনীতি সম্পর্কে সজাগ থাকতে দেখেছি। কোথায় ময়লা-আবর্জনা ফেলতে হবে কিংবা কেমন রাখতে হবে তার চারপাশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ,তারা জানতো। কোনো নাগরিককে ডাস্টবিন ছাড়া আবর্জনা দূর থেকে ছুঁড়ে ফেলতে দেখিনি কখনো। পরে, মানে আজ থেকে ২৫/৩০ বছর আগে দেখেছি অনেক মহিলা জানলা দিয়ে রান্নাঘরের বর্জ্য ফেলছে রাস্তায়। এই কয়েক বছর আগে সুউচ্চ ভবন থেকে কিংবা নিজেদের দোরগোড়া থেকে ময়লার প্যাকটি ছূঁড়ে রাস্তায় ফেলতে দেখেছি। আজকে তার সামান্য পরিবর্তন হলেও ঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাকে বলে তার পূর্ণ কোনো পরিকল্পিত চেহারা আমরা ঢাকায় দেখতে পাচ্ছি না। কাঁচ-বর্জ্য, প্লাস্টিক-বর্জ্য,টাইলস-বর্জ্য, বাতিল কাঠের আসবাবপত্র এগুলো আলাদা আলাদা প্লাস্টিক বিনে ও পলিথিন প্যাকে ভরে, বেঁধে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দেবে বসতিরা, আর সিটির কর্মীগণ তা নিয়ে যাবে। এ-ভাবে, রি-সাইক্লিং সহজ হতো, যা উন্নত দেশগুলোতে করা হয়। প্লাস্টিক ও কাঁচ-বর্জ্য পুনরায় উৎপাদন করে তা ব্যবহারের জন্য বাজারে পাঠানো হলে, কাঁচ বা প্লাস্টিকের উৎপাদন-উপকরণের ঘাটতিও কমবে এবং বাড়তি ব্যয়ও কমবে। আর প্রতিদিনের বাসা-বাড়ির রান্নার বর্জ্য ব্যবহার করে উৎপাদন করা যায় বিদ্যুৎ। আর আমাদের ঢাকা মহানগরের ওই রকম বর্জ্য মিরপুরের পশ্চিম পাশে বিশাল এলাকায় ফেলে তা পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। মাসখানেক আগে আমি সেই বর্জ্য পোড়ানো দেখে এসেছি। বর্জ্য না পুড়িয়ে তা দিয়ে উৎপাদনশীল প্রকল্পের উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের উপায় নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। পুড়িয়ে ফেলাটা বিকল্প হতে পারে না।

তবে বর্জ্য সংগ্রহের পরিকল্পনায় সর্বপ্রথম নিতে হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তাহলো, মহানগরের সিটির আওতাধীন প্রতিটি বাড়ির জন্য তিন থেকে চার রকমের প্লাস্টিক বিন রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্লাস্টিকের জন্য একটি, কাঁচের জন্য একটি, কিচেনের বর্জ্যরে জন্য একটি এবং আরেকটি বাকি বর্জ্য রাখার জন্য। সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরা সপ্তাহে কোন দিন কোন বর্জ্য নিয়ে যাবে, তা আগেই জানিয়ে দেবে বাসিন্দাদের। ওই নোটিশ দীর্ঘদিনের জন্য।

নির্ধারিত দিনে বর্জ্য সংগ্রহকারীরা তা নিয়ে যাবে। প্লাস্টিক ও কাঁচ জাতীয় বর্জ্য সপ্তাহে একদিন, রান্নার বর্জ্য প্রতিদিন, বাকি বর্জ্য নেবে সপ্তাহের একদিন। ফার্নিচারসহ অপরাপর বর্জ্যও সপ্তাহের একদিন নেবে তারা। তাতে করে বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় জট লাগবে না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে কোন কোন ধরনের যান্ত্রিক শিল্প কারখানা গড়ে তোলা যায়, বিশেষ করে রি-সাইকিং করার জন্য প্লাস্টিক, পলিথিনের কারখানা করা যেতে পারে। সেই সাথে প্লাস্টিকের তৈজস সামগ্রী উৎপাদনের জন্য কারখানা যেতে পারে বা বিদ্যমান প্লাস্টিক কারখানাগুলোকেও এ-কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে কর্মসংস্থানও হবে বলে আমরা মনে করি।

ঢাকা মহানগর বাড়ছে প্রতিদিনই। বাড়ছে কিন্তু তা পরিকল্পিত নয়। ফলে এই মহানগরীর একটি অংশ পরিকল্পিত হলেও বাকি অংশ ইট-সুরকির তৈরি বস্তিতে পরিণত হয়েছে এবং হচ্ছে। এ-নিয়ে সিটি করপোরেশনের মাথা ব্যথা থাকলেও তা সমাধানে কোনো পরিকল্পনার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও তার সমাধানের পথও মহানগরবাসীকে জানাতে হবে। সেই বাস্তবায়নের পথে কি কি অসুবিধা হবে, কতো দিনের মধ্যে সেই প্রকল্প সমাপ্ত হবে তা বলতে হবে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে যেন সেই প্রাক্কলিত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পের কাজের সময় ও ব্যয় বাড়ানোর মতো ‘ন্যক্কারজনক’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকাটাই জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ও সিটি করপোরেশনের প্রধান কর্তব্য। আমরা জানি, নানা প্রতিকূলতা আমাদের সরকার ও সিটি করপোরেশনের সামনে আছে। সেগুলো বিবেচনায় রেখেই পরিকল্পনার ব্যয় ও সময় নির্ধারণ করতে হবে।

এখন ঢাকার দুর্ভোগগুলোর অন্যতম হচ্ছে ট্রাফিক জ্যাম। আর এর কারণ মহানগরের বিদ্যমান সড়কগুলো কেটে ফেলে তার ওপরে এলিভেটেড ট্রান্সজিট ট্র্যাক নির্মাণ, যা মেট্রো রেল প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। ঢাকা ম্যাস ট্রান্সজিট কোম্পানি লিমিটেড [ডিএমটিসিএল] নামের এই প্রকল্প তার নির্ধারিত সময়কাল শেষ করে বসে আছে। সরকার তাদের সময় বাড়িয়ে দিয়েছে, বাড়িয়েছে ব্যয়-বরাদ্দও। ফলে মহানগরের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ এখন চরমে। এই প্রকল্পের কাজ কবে শেষ হবে, কেউ তা বলতে পারে না। ২০১৬ সালে এমআরটি লাইন ৬ এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হবার কথা ছিলো ২০২০ সালের মাঝামাঝি। ২০২০ সালের মাঝামাঝি পার করে আমরা ২০২১ সালের ৩ মাসও পার করছি এখন। যে গতিতে মেট্রোরেল-৬ এর কাজ চলছে, তাতে মনে হয় এটুকু পথ শেষ করতে আরো বছর খানেক সময় লাগবে। মোট ৬টি প্রকল্পের আওতায় ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০৩০ সালে, এমনটাই বলা হচ্ছে। আসলে কবে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারে না। ভুল জায়গায় ওভারপাস বা ইউটার্ন নির্মাণ করাও জ্যাম সৃষ্টির কারণ। মশার অত্যাচারের কথা সর্বজনবিদিত। কে খায়নি মশার কামড় এই মহানগরের বাসিন্দাদের মধ্যে? তারপরও মহানগরের দুই মেয়রের শত চেষ্টা সত্তে¡ও মশক সগৌরবে রক্তশোষণ করে চলেছে। এই শোষককে ধ্বংস করতে না পারলে মেয়রদের গৌরব করার কিছুই থাকবে না। যে সব সমস্যার দীর্ঘমেয়াদে সমাধান সম্ভব, যেমন মশা নিধন, সেটা মেয়রদের করে দেখানো উচিত। তখন তারা গর্ব করে বলতে পারবেন যে অন্তত একটি সমস্যার সমাধান তারা করতে পেরেছেন। মশা মারা কয়েল নির্মাতা কোম্পানিগুলোর কাছে থেকে মালপানি নিলে তো আর মশক নিধন অষুধের কোয়ালিটি পানির মতোই জলবৎ তরলং হতে বাধ্য।ভোগান্তির আরেক নাম সরকারি অফিস। যারা ভোক্তভোগী তারা কথাটা মানবেন। যারা সরকারি দল করেন, তারা মানবেন না। এইটা আমাদের রাজনৈতিক স্বভাব। নিজ দলের সরকারের ফল্টকে ফল্ট বলতেও চায় না তারা, তারা দলদাস। আবার তারাই যখন বিরোধী বেঞ্চে বসেন তারা তখন ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে একই রকম অভিযোগ করেন। সাধারণ মানুষ অভিযোগ করেন না। তারা কেবল ‘নীরবে সয়ে যায়’। ঝিনুক যেমন নীরবে সয়ে যায়’ তার সারা জীবন। জনগণ হচ্ছে সেই মুখ বুজে সয়ে যাওয়া ঝিনুক। বুকের কষ্ট সহ্য করে সে ফলায় মুক্তা। এতো অন্যায় সত্তে¡ও কৃষক নীরবে উৎপাদন করে তার কষ্টের ফসল। আর সেই ফসল নিয়ে ডমফাই করে সরকার ও তার লেজুড়ের দল। এটাই কৃষকের নিয়তি, আমাদের মতো উন্নয়নশীল নামক দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম