এমন একদিন ছিল যখন জেলার সিনেমা হলগুলো দর্শকে ঠাসা থাকত। প্রতিদিন ৪টি করে শো হতো। তাও দর্শকের কোনো কমতি ছিল না। কোনো কোনো ছবির ব্যাপক দর্শক চাহিদার কারণে এক মাস ধরে চলেছে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে হলগুলোতে দর্শক কমতে থাকে আশংকাজনক হারে।
বর্তমানে জেলার হলগুলো সম্পূর্ণই বন্ধ হয়ে গেছে। গত কয়েক বছর আগেও প্রতি ঈদ এবং পূজাকে সামনে রেখে হল মালিকরা নতুন ছবি এনে হলগুলো চালাতেন। কিন্তু এখন জেলার ৪টি সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গেছে দর্শকশূন্যতায়। এমনকি হলোগুলোর অবকাঠামোও ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে বলিউডের সিনেমা আমদানি করে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত এবং সরকার থেকে বিভিন্ন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে আবারও হল মালিকরা ব্যবসার ঝুঁকি নিতে চান বলে জানিয়েছেন তারা।
জানা যায়, ১৯৭০ সালে নড়াইল শহরে চিত্রাবাণী, ১৯৯০ সালে কালিয়ায় আলপনা ও ২০০১ সালে লোহাগড়া উপজেলায় সেভেনস্টার সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা হয়। সদর উপজেলার গোবরা বাজারেও একটি সিনেমা হল গড়ে ওঠে। সেসময় প্রত্যেকটি সিনেমা হলই ভালো চলেছে। হল মালিকরা রমরমা ব্যবসা করেছেন। তখন হলের সিট ক্যাপাসিটি ভালো না হলেও দর্শকের কমতি ছিল না।
৯০’র দশক থেকে বিভিন্ন কারণে সিনেমা হলগুলোতে দর্শক কমতে থাকে এবং গত কয়েক বছর আগে একে একে দর্শক শূন্যতায় জেলার ৪টি সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি হলোগুলোর অবকাঠামোও ভেঙে ফেলা হয়েছে। সর্বশেষ ৪ মাস আগে নড়াইল জেলার সবচেয়ে পুরোনো এবং জনপ্রিয় চিত্রাবাণী সিনেমা হলের অবকাঠানো ভেঙে ফেলা হয়।
এক সময়কার সিনেমা দর্শক সুজয় কুমার বকসী। তার মতে, সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়েছে ডিসলাইন আসা, কুরুচিপূর্ণ সিনেমা চালানো, হলের পরিবেশ ভালো না হওয়া, সামাজিক এবং পারিবারিক কাহিনী নিয়ে সিনেমা তৈরি না হওয়ায়। বর্তমানের সিনেমাগুলোতে যে ধরনের কাহিনী, ডায়লগ এবং দৃশ্য থাকে সেটা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেখা যায় না বলেই সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
এডিশনাল পিপি অ্যাডভোকেট আলমগীর সিদ্দিকী বলেন, এক সময় চিত্রাবাণী সিনেমা হলে ছারপোকার কামড় খেয়েও সিনেমা দেখেছি। তখন কত আনন্দ করতাম, দর্শকও হত প্রচুর। কিন্তু বর্তমানে সিনেমাগুলোতে ভালো কাহিনী না থাকা ও অশ্লীল দৃশ্যের কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেখা যায় না। ফলে সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করেছি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, নড়াইল জেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং মূর্ছনা সংগীত নিকেতনের সভাপতি শামীমুল ইসলাম টুলু বলেন, চলচিত্র একটি দেশের অন্যতম একটি শিল্প এবং গণমাধ্যম। এর মাধ্যমে আমরা সে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারি এবং শিক্ষণীয় সুস্থ বিনোদন উপভোগ করি। একটি প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণে সরকারের ভর্তুকি দিয়ে হলেও চলচ্চিত্রকে টিকিয়ে রাখা উচিত।
নড়াইল প্রেসক্লাবের সভাপতি এনামুল কবীর টুকু বলেন, আমাদের সিনেমা হলগুলো বন্ধ হওয়ার মূল কারণ হলের খারাপ পরিবেশ এবং ভালো মানের সিনেমা না হওয়া। তার উপর ইন্টারনেট, ইউটিউবের প্রচলন এখন অনেক বেশি। ভারতীয় হলগুলো ভালোভাবে চলছে, কারণ তাদের সিনেমার মান ভালো। ওই আদলে যদি সিনেমা তৈরি ও হলের পরিবেশ ভালো করা যায় তাহলে নড়াইলেও আবার হলগুলোতে সিনেমা দেখতে যাবে মানুষ।
নড়াইল চিত্রাবাণী সিনেমা হলের মালিক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বাবু জানান, সিনেমা হলের ব্যবসা এক সময় জমজমাট চললেও ৯০’র দশক থেকে ডিসলাইন ক্যাবলের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি সিনেমা দেখার সুযোগ সৃষ্টির পর থেকে সিনেমা হলগুলোতে দর্শক আসা কমতে থাকে। বিধায় ২০১৪ সালে দর্শক না হওয়ায় আমাকে আর্থিক লোকসানের কারণে সিনেমা হল বন্ধ করতে হয়েছে।
বর্তমান সরকারের সিনেমা হল চালুর জন্য হল মালিকদের অনুদান এবং দেশি সিনেমার পাশাপাশি বলিউডের সিনেমা আমদানির সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের সুযোগ পেলে পুনরায় এ ব্যবসার ঝুঁকি নিতে চান।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, যুব সমাজের জন্য জেলা শহরসহ সকল উপজেলায় একটি করে সিনেমা হল প্রয়োজন। জাতীয় দিবসগুলো যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসগুলোতে ডকুমেন্টারি ও অন্যান্য দিবসে সরকারের উন্নয়নমূলক প্রচারের জন্য সিনেপ্লেক্স প্রয়োজন। তাই হল মালিকদের সরকারের পক্ষে যে সহযোগিতা প্রয়োজন সেটা করা হবে।
হাফিজুল নিলু/এফএ/জিকেএস