দেশজুড়ে

নেছারাবাদে ছোবড়া শিল্পে অপার সম্ভাবনা

নদীবেষ্টিত পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বিভিন্ন শিল্পের সমাহার। উপজেলাটি সন্ধ্যা নদীর তীরবর্তী হওয়ায়, সেখানে প্রাকৃতিকভাবেই এসব শিল্প দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। নদীর পূর্ব পাড়ে ৪টি ইউনিয়ন এবং নদীর পশ্চিম পাড়ে ৬টি ইউনিয়ন রয়েছে। ইন্দুরহাট, মিয়ারহাটে গড়ে উঠেছে আরও দুটি বড় বন্দর, যাদের পরিচিতি রয়েছে দেশব্যাপী।

এছাড়া দৈহারী, গণকপাড়া, ডুবি, আলকিরহাট, করফা, চিলতলা বাজারসহ আরও ৭ থেকে ৮টি ছোট-বড় বাজার রয়েছে। নেছারাবাদের উত্তরে বরিশালের বানারিপাড়া, পূর্বে ঝালকাঠি জেলা, দক্ষিণে কাউখালী উপজেলা ও পশ্চিমে নাজিরপুর উপজেলা। এ উপজেলার বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি পাপোশ ও ম্যাট তৈরি অন্যতম।

ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে জীবিকা নির্বাহের জন্য শ্রীলংকায় পাড়ি দেন উপজেলার বালিহারী গ্রামের আসমত আলী। সেখান থেকে তিনি ছোবড়া দিয়ে পাপোশ তৈরি করার প্রক্রিয়া দেখে আসেন। এরপর দেশে ফিরে নিজ গ্রামে নারিকেলের ছোবড়ার আঁশ ছাড়িয়ে তা থেকে প্রথমে দড়ি ও পরে দড়ি থেকে পাপোশ তৈরি করেন তিনি।

দিন দিন ছোবড়ার দড়ি ও পাপোশের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এলাকার কিছু ব্যবসায়ী এই ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময় শ্রীলংকা থেকে পাকিস্তানে পাপোশ আমদানি করা হতো। তবে পরে পাকিস্তানে পাপোশ রফতানি করা হয় এখান থেকে। এক সময় এ অঞ্চলে ছোবড়া শিল্পের ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তা ও সরকারের প্রচেষ্টায় ১৯৬১ সালে উপজেলার কৌড়িখাড়া এলাকায় বিসিক শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠিত হয়।

নেছারাবাদ উপজেলার বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের আওতায় অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা থেকে বিসিক উদ্যোক্তা গড়ে উঠছে প্রতি বছর। পাপোশ শিল্প এদের মধ্যে অন্যতম। তবে পাপোশ তৈরির জন্য নরিকেলের ছোবড়া মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে নারিকেল শুকানোর আগেই ডাব নারিকেল হিসেবে তার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায়, শুকনো নারিকেলের ছোবড়া কম পাওয়া যায় এবং যা পাওয়া যায় তার দামও অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন ছোবড়া ব্যবসায়ীরা। সেই নারিকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি হয় পাপোশ।

স্বাধীনতার পূর্বে ‘কয়ার ইন্ডাস্ট্রি’ নামে পাকিস্তান সরকার প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠানে এই পণ্য উৎপাদন করা হতো। স্বাধীনতার পরে প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তিমালিকানায় চলে যায়। বর্তমানে ‘রানা-রাব্বী ইন্ডাস্ট্রি” নামে প্রতিষ্ঠানটি চলছে। এ শিল্প এলাকায় আরও পাঁচটি ছোবড়া শিল্পের আধুনিক কারখানা গড়ে উঠেছে। নারিকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি করা হয় দড়ি। সেই দড়ি থেকে তৈরি হয় ক্রিকেট মাঠের ম্যাট, যা পিরোজপুরসহ সারাদেশের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ছোবড়া কারখানার শ্রমিক মো. মিরাজ হাওলাদার বলেন, পিরোজপুর ও বাগেরহাটের বিভিন্ন জায়গা থেকে নারিকেলের ছোবড়া আনা হয়। তারপর মেশিন থেকে আঁশ বানাই। আঁশ দিয়ে পাপোশ তৈরি হয়। তারপর আবার এই আঁশ দিয়ে ব্রাশের তুলি ও চিকন কাতড়াও বানানো হয়। গাছের চাড়ার গোড়ায় দিতে ছোবড়ার গুড়ি নার্সারিতে বিক্রি করা হয়। এক বস্তা গুড়ি বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়।

পাপোশ শ্রমিক নিখিল চন্দ্র বলেন, এই শিল্পের কাচামাল আমরা বিভিন্ন বাজার থেকে কিনে আনি। তারপর কারখানায় পাপোশ তৈরি করে এগুলোকে বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই (সরবরাহ) দেই। আমাদের এখানে অনেক কারিগর আছে। নারীদের দিয়েও অনেক কাজ করানো হয়। কারণ নারীদের টাকা কম দিলেও হয়। পুরুষ করলে এই কাজে লাভ হয় না। পাপোশ তৈরি করে বাজারে নিয়ে গেলে দেশের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে পাইকাররা আসে। তারা কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই দেয়। ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে এই পাপোশ তৈরির কাজ করছি। এই দিয়েই আমাদের সংসার চলে। সরকারের যদি আমাদের কিছু ঋণ দিয়ে সাহায্য করে, তাহলে আমরা আরও ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারবো।

ম্যাট শ্রমিক সালাম বয়াতী বলেন, এই ক্রিকেট ম্যাটের উপর ক্রিকেট খেলে। ছোবড়া দিয়ে দড়ি পাকিয়ে ক্রিকেট ম্যাট বানানো হয়। মালিক আমাদের কাঁচামাল বুঝিয়ে দেন। আমরা মালিককে ম্যাট বানিয়ে বুঝিয়ে দেই।

দি পিপলস কয়ার ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মো. মহিউদ্দিন বলেন, আমাদের কারখানায় পাপোশ ও ক্রিকেট খেলার ম্যাট তৈরি করা হয়। নারিকেলের ছোবড়া সংগ্রহ করি বাগেরহাট থেকে, তারপর কারখানায় রশি পাকিয়ে ম্যাট ও পাপোশ বানানো হয়। ক্রিকেট ম্যাট আমাদের এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যায়। একটি ম্যাটের দাম বর্তমানে ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো। একটা ম্যাট ৭-৮ বছর ব্যবহার করা যায়। বছরে ২৫-৩০টা ম্যাট চলে। ছোট পাপোশগুলোর অনেক চাহিদা রয়েছে।

পিরোজপুর জেলা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন বিসিক কর্মকর্তা মিল্টন বৈরাগী বলেন, বর্তমানে বিসিক শিল্প নগরে মোট ১৬৭টি প্লট আছে, যার মধ্যে বরাদ্দ প্লট সংখ্যা ১৪৪টি, বরাদ্দ শিল্প ইউনিট ৯৯টি, উৎপাদনরত শিল্প ইউনিট ৫৯টি এবং ২৬টি প্লট বরাদ্দের অপেক্ষায় আছে। পিরোজপুরে আমরা উদ্যোক্তা তৈরি করি। সেক্ষেত্রে আমরা প্রথমে উদ্যোক্তা চিহ্নিত করে তাদের প্রশিক্ষণ, ঋণ কার্যক্রম পর্যন্ত করে থাকি। আমাদের বিসিক শিল্প নগরীতে উদ্যোক্তাদের জন্য প্লট বরাদ্দ দান, প্রোজেক্ট প্রোফাইল, লেআউট প্লানসহ সবকিছুই আমরা করি।

তিনি আরও বলেন, ২০২০-২০২১ অর্থবছরের আমরা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ১৫০ জন উদ্যোক্তাকে বাছাই করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এখান থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ উদ্যোক্তা সফলভাবে তৈরি হয়ে গেছে। সফলভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। তাদের ঋণের চাহিদা রয়েছে। ব্যাংকের নিয়মকানুন মেনে তাদেরকে ঋণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তাদের পণ্যগুলো বিভিন্ন মেলায় প্রদর্শনী করাসহ অনলাইনে বিক্রির সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে।

এমএসএইচ/এমকেএইচ