‘উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপানো বলতে একটি কথা আছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’-নামে একটি পলিসি গ্রহণ করেছে। এই পলিসি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নাগরিকের সমমর্যাদা দিলে তারা বাংলাদেশকে ঋণ দেবে। ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রোহিঙ্গাদের স্থানীয় বাজারসহ দেশের সর্বত্র অবাধে চলাচলের সুযোগ দিতে হবে ও তাদের বাংলা ভাষায় শিক্ষাদানেরও সুযোগ দিতে হবে।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। এ ষড়যন্ত্রে বর্তমানে শুধু মিয়ানমার একাই অংশীদার না, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য বিশ্বসংস্থাও এই ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রশ্নে জাতিসংঘ, রিফিউজিসংস্থাসহ অন্যান্য কোনো বিশ্বসংস্থাই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এগিয়ে আসেনি। দায়সারা গোছের নিন্দা ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মধ্য দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবের তিনটি মূল বিষয় হলো-(১) উদ্বাস্তুদের জন্য বাংলাদেশেই অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করা এবং (২) বাংলাদেশে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া। তৃতীয় শর্তটি হচ্ছে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো এবং গ্রহণকারী দেশের (বাংলাদেশ) সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাতে করে নতুন উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয়। তৃতীয় শর্তাংশে তারা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছে বটে, তবে যদি তারা নিজ দেশে না যায় সেক্ষেত্রে গ্রহণকারী দেশের (বাংলাদেশের) সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাতে করে নতুন আরও উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়া সম্ভব হয়। অর্থাৎ বিদ্যমান উদ্বাস্তুদের শুধু গ্রহণ করা নয়, নতুন আরো উদ্বাস্তু গ্রহণ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছে এই শর্তে। যেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোই একমাত্র আইনগত ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধান সেখানে বিদ্যমান রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করা ও সেই সঙ্গে আরও রোহিঙ্গা গ্রহণ করার সক্ষমতা বৃদ্ধির শর্ত যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ তা বলাই বাহুল্য।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাখাইনে আরও যে ৬ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদেরকে তাড়িয়ে দিতে বদ্ধ পরিকর। সে কারণেই বাংলাদেশের ওপর আগাম এই শর্ত চাপিয়ে দেয়ার পায়তারা। এই শর্ত গ্রহণ করলে আগামীতে বিশ্বব্যাংক বলবে, আমরা তো তোমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য সাহায্য করেছি এখন রোহিঙ্গাদের তোমরা গ্রহণ করো।
২০১৭ সালের পর ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এদেশে অনুপ্রবেশ করে। এনিয়ে মোটের ওপর বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী এখানে অবস্থান করছে। ভুটানের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি একটি জনগোষ্ঠীর বোঝা আমাদের বইতে হচ্ছে। ভুটানের জনসংখ্যা ৮ লাখ আর বালাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখ রোহিঙ্গা।
আন্তর্জাতিক শরণার্থী বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ দুইটি আইনি দলিল হচ্ছে ১৯৫১ সালের কনভেনশন ও ১৯৬৭ সালের প্রটোকল। এ দুইটি ডকুমেন্টই প্রণয়ন করা হয়েছে ইউরোপের শরণার্থী বিষয়ক সমস্যার সমাধানের জন্য। ১৯৫১ সালের কনভেনশনে বলা হয়েছে, শরণার্থীদেরকে জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না। বাংলাদেশ কনভেনশনের সেই শর্ত মেনে নিয়েছে। যেকোনো কারণেই হোক বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জোর করে নিজ দেশ ফেরত পাঠাতে পারেনি। অন্যান্য দেশ তাদের সীমান্ত পাড়ি দিলে গুলি করে মানুষ মারে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ওপর গুলি চালাতে পারিনি। এটি একটি মানবিক ব্যর্থতা ও একই সঙ্গে মানবিক সাফল্যও। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় আমাদের এই মানবিকতা ও উদারতাকে দূর্বলতা হিসেবেই বিবেচনা করছে যার ফলে আমরা দেখছি তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর কোনো কার্যকর চাপই দিচ্ছে না। উল্টো বাংলাদেশের ওপরউ চাপিয়ে দিচ্ছে অযৌক্তিক ঋণের শর্ত।
বিশ্বব্যাংক সহায়তার নাম নিয়ে আমাদের ওপর অযৌক্তিক ও অন্যায় শর্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। আমরা জানি মিয়ানমারে ইউরোপীয়-আমেরিকান বিনিয়োগ আছে। বিশ্বব্যাংক আদতে তাদেরই স্বার্থ রক্ষা করতে এই আজব শর্ত চাপিয়ে দিতে চায় বাংলাদেশর ওপর। এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের মাধমে পুরো রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করে বিশ্বব্যাংক কার স্বার্থ হাসিল করতে চায় তা পরিষ্কার।
বিশ্বব্যাংক-যুক্তরাষ্ট্র তথা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকেই তুষ্ট করতে চায়। ইউরোপীয় ব্যবসা-বাণিজ্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই সঙ্গে এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলোও নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। গণহত্যায় অভিযুক্ত ও দীর্ঘ সামরিক শাসনে থাকার পরও মিয়ানমারের সঙ্গেই সব ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। আগে সেনাবাহিনী পর্দার অন্তরালে থেকে দেশ শাসন করেছে। শান্তির খেতাবধারীকে সামনে রেখে গণহত্যা চালিয়েছে। আর এখন তারা নিজেরাই গদিতে বসেছে। সু চি ক্ষমতার ভাগীদার হওয়ার আগে গণতন্ত্রের বুলি আওড়িয়ে শান্তিপদক পেয়েছেন আর ক্ষমতার ভাগীদার হয়ে গণতন্ত্র ও গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সামরিক বাহিনীও তাকে যতটুকু প্রয়োজন ছিল ব্যবহার করেছে। এখন প্রয়োজন শেষে সু চিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। বিশ্ববাসীও এক সময় সু চিকে সমর্থন দিয়েছে। এখন কেউ সু চির নামও নেয় না। সবাইকেই যার যার অপকর্মের কাফফারা দিতে হয়। সু চিকেও তাই দিতে হচ্ছে। মাঝে একটি জনগোষ্ঠী হারিয়েছে তার চিরদিনের ভিটে-মাটি-দেশ। শরণার্থী হয়েছে বাংলাদেশে।
সমগ্র বিশ্ববাসী জানে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের দায়। এমনকি অং সান সু চিও আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানির সময় দাবি করেননি যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক। বলেছেন, এরা আরাকান মুসলমান। আরাকান অঞ্চলটি তো মিয়ানমারেরই অংশ।
বিশ্বব্যাংকের এ প্রস্তাব বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের স্বাভাবকি প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত করবে। তাই বিশ্বব্যাংকের উচিত তাদের এ অযৌক্তিক শর্ত প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে ঋণ প্রদান করতে এগিয়ে আসা।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশ্বব্যাংকের ওই প্রস্তাব যথাযথভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছে। একইভাবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে জোর দাবি জানিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য ও বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। পৃথিবীর যে সব দেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে (মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ইত্যাদি) তাদের সঙ্গে এক সাথে আওয়াজ তুলতে হবে। বিশ্ব গণমাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্যাতনের চিত্রও তুলে ধরতে হবে।
আন্তর্জাতিক আইনে রোহিঙ্গারা একটি পৃথক জনগোষ্ঠী। আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) তাদেরকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছে। ওই আদালতে মিয়ানমার, চীন, ভারত ও রাশিয়ার বিচারকরাও ছিলেন। কোনো বিচারকই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেননি। আন্তর্জাতিক আদালত সর্বসম্মতভাবেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের এই আইনগত স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। অপরাপর সব কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগও চালিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশর নৈতিক ও আইনগত দৃঢ় অবস্থান অব্যাহতভাবেই তুলে ধরতে হবে।
এইচআর/এমএস