দেশে মশা তাড়াতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় কয়েল। যদিও দেশে কতটি ব্র্যান্ডের কয়েল বা উৎপাদনের কতগুলো কারখানা রয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে সে তথ্য নেই সরকারের কোনো দপ্তরে। ‘ধারণার ভিত্তিতে’ তারা বলছেন, সারাদেশে কমপক্ষে হাজারখানেক কারখানা রয়েছে যেখানে বৈধ, অবৈধ দুই উপায়েই কয়েল তৈরি হচ্ছে। আবার এসব কারখানার অধিকাংশেরই নেই অনুমোদন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধুমাত্র যাত্রাবাড়ী, টঙ্গী, ভৈরব, নারায়ণগঞ্জ আর সাভারেই রয়েছে মোট কারখানার অর্ধেক। বাকিগুলো সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এমন অনেক কয়েল কারখানা রয়েছে, যেগুলো অঞ্চলভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনা করে। সেগুলোর অধিকাংশই খুবই নিম্নমানের।
কয়েল ছাড়াও মশা মারার স্প্রে (অ্যারোসল), ক্রিম বা লোশনজাতীয় পণ্য, বৈদ্যুতিক ব্যাটসহ মশা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সামগ্রীর ব্যবহার রয়েছে দেশে। এগুলোর কোনোটা উৎপাদন করা হয় আবার কোনোটা করা হয় আমদানি।
দেশে এসব সামগ্রীর হাজারের বেশি ব্র্যান্ড থাকলেও অনুমতি রয়েছে মাত্র ১০৩টির। এছাড়া কিছু সামগ্রীর অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতাও নেই। ফলে সেসবে নেই কোনো নজরদারিও।
এ অবস্থায় দেশে ব্যবসা হারাচ্ছে কয়েলের বড় ব্র্যান্ডগুলো। অনেক কোম্পানি এ পণ্য উৎপাদন বন্ধ করেছে। এর মধ্যে কয়েক বছর আগেও দেশের মশার কয়েলের বাজারে সবচেয়ে বেশি হিস্যা থাকা মরটিন ব্র্যান্ডের কয়েল কারখানা এখন বন্ধ।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দেশে এখন ব্যাঙের ছাতার মতো কয়েল কারখানা গড়ে উঠেছে যারা ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করে কয়েল উৎপাদন করে। এটা বড় ব্র্যান্ডগুলো ব্যবহার করতে পারে না। এছাড়া প্রচুর নিম্নমানের কয়েল আমদানিও হচ্ছে চীন থেকে।
ফলে গত কয়েকবছরে দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত অনেক ব্র্যান্ড বাজার হারিয়েছে। আর দুই-তৃতীয়াংশ বাজার চলে গেছে আমদানি ও নিম্নমানের কয়েলের দখলে।
এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা মহানগরীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচতে ভরসা করতে হচ্ছে ওইসব ক্ষতিকর কয়েলের ওপরই।
অধিকাংশ ব্যবহারকারী বলছেন, এসব সামগ্রীতেও মুক্তি মিলছে না ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ থেকে। বরং এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে নগরবাসী। সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক নজরদারি না থাকায় এসব উপকরণ কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ঠকছেনও ক্রেতারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন। তিনি ২০০২ সাল থেকে বিভিন্ন মশা ও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণসামগ্রী পরীক্ষা করে আসছেন নিয়মিত।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মশা তাড়ানোর কয়েলের ব্র্যান্ডের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু অধিকাংশ কয়েলে নির্ধারিত মানের থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় কেমিক্যালের ব্যবহার হয়েছে। যেটা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। এছাড়া দেশে স্প্রে বা ক্রিমের কোনো স্ট্যান্ডার্ড নেই। সেজন্য কার্যকর না অকার্যকর সেটা আমরা প্রমাণ করতে পারি না।’
মশা নিয়ন্ত্রণে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো কার্যকর নয়। খুব একটা কাজে আসে না। এছাড়া আরও সমস্যা রয়েছে। যে পণ্যগুলো কার্যকর সেগুলোর আসলটি বাজারে পাওয়াও মুশকিল। প্রচুর নকল পণ্য রয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএসটিআইয়ের মান সার্টিফিকেট রয়েছে মাত্র ১০৩টি কয়েলের ব্র্যান্ডের। বাকি সব অননুমোদিত। আইন অনুযায়ী, এ প্রতিষ্ঠানগুলোই শুধু তদারকি করতে পারে সংস্থাটি। এছাড়া অ্যারোসল, লোশন বা ক্রিমজাতীয় পণ্যের উৎপাদন বা আমদানি বাড়ার পরও এসব সামগ্রীর জন্য নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ।
শুধু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং থেকে একটি লাইসেন্স নিয়ে এসব পণ্য বিদেশ থেকে আনা অথবা তৈরি করা যায়। সেখানেও এ পর্যন্ত ৪৫০টির বেশি ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ধরনের মশার ওষুধের (অ্যারোসল, ক্রিম ও অন্যান্য) লাইসেন্স দিয়েছে সংস্থাটি। যার অধিকাংশই আমদানি করা।
এসব বিষয়ে কাজ করার কথা বিএসটিআইয়ের সিএম শাখার। সেখানে পরিচালক ছিলেন সাজ্জাদুল বারী। তিনি সদ্য পরিচালক (মেট্রোলজি) হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাধ্যতামূলক পণ্য না হওয়ায় কয়েল ছাড়া মশা বিতাড়নের অন্যান্য পণ্যে তদারকি করা যাচ্ছে না। এছাড়া আমাদের কাছে অন্যান্য স্প্রে বা ক্রিমের কোনো স্ট্যান্ডার্ড নেই। সেজন্য কার্যকর কি না, সেটি আমরা প্রমাণ করতে পারি না।’
কয়েলেও যথেষ্ট তদারকি হচ্ছে কি না জানতে চাইলে সিএম শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের সিএম লাইসেন্স নেয়া ব্র্যান্ড কারা তা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেই। কিন্তু নকল ও নিম্নমানের এতো বেশি কারখানা আছে যে, সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তারপরও মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। জেল-জরিমানাসহ কারখানা সিলগালাও করছে বিএসটিআই।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাবলিক হেলথ গ্রেড অর্থাৎ মানব শরীরের সংস্পর্শে আসা এসব পণ্যের জন্য নির্ধারিত কীটনাশকের ব্যবহারযোগ্য মাত্রা রয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণত মশার কয়েল ও স্প্রেতে পারমেথ্রিন, বায়ো-অ্যালোথ্রিন, টেট্রাথ্রিন, ইমিপোথ্রিনের মতো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। কোনো পণ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় এসব ব্যবহার হলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি দীর্ঘমেয়াদে কিডনি রোগ এবং ক্যান্সারেরও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
এদিকে মশা মারার জন্য তৈরি বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলোরও একই অবস্থা। মানের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সেগুলো ব্যবহার করেও সন্তুষ্টি মিলছে না সাধারণ মানুষের। কিনতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন বেশিরভাগ ক্রেতা।
এনএইচ/এমএইচআর/এমএস