মতামত

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও জনদুর্ভোগ

প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী

কোন প্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গত ৪ নভেম্বর থেকে আকস্মিকভাবে দেশে বহুল ব্যবহৃত জ্বালানি তেল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করায় ভোগ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জনদুর্ভোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমরা সবাই জানি যে দেশের অধিকাংশ গণপরিবহন বিশেষ করে বাস, ট্রাক কাভার্ড ভ্যান ডিজেল চালিত। সুতরাং ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সঙ্গত কারণে যানবাহনের ভাড়া বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে, জনগণের যাতায়াত খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পাবে। এটা সবারই জানা যে আমাদের দেশের কৃষি খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মহামারি করোনা কালে দেশের কৃষিখাত ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল বলেই হয়তো আমাদের অর্থনীতির গতি এখনও সচল।

দেশের কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে ডিজেলের ব্যবহার অপরিহার্য। ফলে ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন ব্যয় অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। সামনে বোরো মৌসুম। বোরো চাষে সেচের জন্য ব্যবহৃত সেচ যন্ত্রের অধিকাংশ ডিজেল চালিত। ফলে বোরো ধান চাষের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে চালের দাম বেড়ে যাবে। এমনিতেই বর্তমানে চাল-ডালসহ নিত্যব্যবহৃত দ্রব্যমূল্য নিম্ম মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দেশের প্রান্তিক জনপদের গরিব মানুষ ও চরাঞ্চলে বসবাস কারি মানুষেরাই বলতে গেলে কেরোসিন ব্যবহার করে থাকে। কেরোসিনের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি খেটে খাওয়া গবির মানুষের জীবন মানের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। তাদের চলমান অভাব ও দুঃখ কষ্টকে বাড়িয়ে দিবে। কেরোসিন ধনিক শ্রেণির মানুষেরা মোটেই ব্যবহার করে না বা ব্যবহার করার প্রয়োজনও পড়ে না। তাই কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি মোটেই বোধগম্য নয়। এটা কাম্যও নয়। কেরোসিনের এই মূল্যবৃদ্ধি দিন আনা দিন খাওয়া গরিব শ্রেণির মানুষদের জীবন-মানকে আরো নিম্নমুখী করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

দেশের কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের অনেকগুলোতেই জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহৃত হবার কারণে বিদ্যুত উৎপাদনের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। প্রান্তিক জনপদের যেখানে বিদ্যুতের অপ্রতুলতা রয়েছে সেসব জায়গায় কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত সেচ যন্ত্রে ব্যাপক পরিমাণে ডিজেল ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন খরচ যে এক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাবে তা বলাই যায়। বোরো মৌসুম অত্যাসন্ন। বোরো চাষের সেচ ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে ডিজেল চালিত শ্যালো মেশিন। তাই ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধি পেলে তা সরাসরি দেশের বোরো চাষে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য এই মুহূর্তে বেশ চড়া। ভোজ্য তেলের দামও লিটারে ৮/৯ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। মৌসুমি শাক-সবজির দামও অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশ চড়া। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এই পরিস্থিতিকে আরো উস্কিয়ে দিতে পারে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে

নিম্নআয়ের মানুষের জীবন-যাপনের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে আরও বেগবান করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

আমরা জানি করোনাকালে বহু মানুষ চাকরি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনেকেই পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। কেউ কেউ আবার চাকরি হারিয়ে পেশা বদলিয়ে কৃষিকে তাদের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। করোনাকালে কৃষি আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। এখন ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি দেশের বিকাশমান কৃষিখাতকে বড় ধরনের একটি সংকটের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। আমরা এও জানি যে, ডিজেল বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষ করে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্লানগুলোর অধিকাংশই ডিজেল বা ফার্নেস অয়েল দ্বারা চালিত হয়ে থাকে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশের উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ওপরে অনেকটা নির্ভরশীল। গ্যাসের অপ্রতুলতা বিদ্যুৎ এবং ডিজেলের উপর নির্ভরশীলতাকে অনেকাংশেই বৃদ্ধি করে দিয়েছে। সুতরাং এই মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে জনগণের উপর 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবে দেখা দেবে এবং তাদের ভোগান্তিকে অনেকাংশে বৃদ্ধি করবে। তাছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ভোক্তা পর্যায়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

চাকুরীজীবী মানুষের বেতন কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এক টাকাও বাড়েনি। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের দাম বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মহীন সকল মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে একথা বলার মত সময় এখনও আসেনি। এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে এই মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি দেশের কৃষি অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকার বা সংশ্লিষ্টরা এর নেতিবাচক দিক বিবেচনা করেছে কিনা তা আমার জানা নেই তবে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি নিশ্চিত করে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধিকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সার্বিক বিচারে নিম্নমধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক মানুষের জীবনমানের ধারাকে অবনমন করবে।

আমাদের দেশের অর্থনীতি এখনো অনেকটা কৃষিনির্ভর। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি কোন সুখকর বিষয় হতে পারে না।

এদিকে তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথেই দেশে ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বেসরকারি খাতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের এলপিজি'র দাম মূসকসহ পূর্বের এক হাজার ২৫৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৩১৭ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে যা গত ৪ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে।

এই এলপিজি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে গৃহস্থালি কাজে রান্নার ব্যয় ভোক্তা পর্যায়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া এলপিজি'র এই মূল্যবৃদ্ধি হোটেল রেস্টুরেন্ট এর খাবার দামের উপরে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ এখন থেকে ভোক্তাকে অতিরিক্ত মূল্যে হোটেল রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে খেতে হবে।

যা নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনমানের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এদিকে গাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজি'র দামও বৃদ্ধি করে তা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে যা ইতিমধ্যেই কার্যকর করা হয়েছে। পূর্বের ১ লিটার এলপিজি গ্যাসের দাম ৫৮ টাকা আষট্টি পয়সা হলেও এখন তা বাড়িয়ে ৬১ টাকা ১৮ পয়সা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। মোটাদাগে বলতে গেলে জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি জনদুর্ভোগকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাবে, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, সার্বিক বিচারে জনগণের জীবনমানের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের জীবন যাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। সরকার নিশ্চয় বিষয়টি ভেবে দেখবে। জনদুর্ভোগ লাঘবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করবে।

লেখক : আইবিএ,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।drhasnat77@gmail.com

এইচআর/এএসএম