মতামত

ভালোবাসা সবার তরে...

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা বিরাজ করুক প্রতিটি হৃদয়ে আর বিশ্বময় প্রেমপ্রীতিময় সম্পর্কের বিস্তার ঘটবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সব মানুষ এবং প্রতিটি ধর্মই শান্তি ও ভালোবাসা চায়। তাই তো আমরা সেই ধর্ম সম্পর্কে ভীত, যে ধর্ম সন্ত্রাসবাদ, বিস্ফোরণ এবং আত্মঘাতী বোমা দ্বারা নিরীহ লোকদের রক্তপাত ঘটায়। আমরা সেই ধর্ম সম্পর্কে ভীত, যে ধর্ম ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ঘৃণা ও শত্রুতার বিস্তার ঘটায় এবং শক্তির সাহায্যে এর বার্তাকে প্রসারিত করতে চায়।

আসলে প্রকৃত ইসলামের সাথে এসবের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম হচ্ছে উল্লিখিত যাবতীয় মন্দ-বিষয়াদীর বিপরীত এক ধর্ম। আসল ইসলাম হচ্ছে সেই ধর্ম, যার উল্লেখ মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে রয়েছে এবং যা ইসলামের পবিত্র নবীর (সা.) মহান ব্যবহারিক জীবনাচরণ দ্বারা সমর্থিত। তার বিপরীত এবং বিরোধী কোনো কিছুই ইসলাম নয়।

ইসলামের আসল-শিক্ষা এবং নৈরাজ্যবাদীদের সেসব মনগড়া ব্যাখ্যাকৃত মত ও আচরণের মধ্যে আমাদের সুস্পষ্ট-পার্থক্য করতে হবে, যারা ইসলামের নামের বিকৃতি ঘটাচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে, এ যুগে এক বৃহৎজনসমষ্টি ইসলামের সৌন্দর্যকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যে ব্যক্তি প্রকৃত অর্থেই ইসলামে বিশ্বাস করে, তাকে মুসলমান বলে। আর প্রকৃত ও খাঁটি মুসলমান সে, যার হাত এবং যার জিহ্বা থেকে সব মানুষই সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ।’ (সুনান নিসাই, ৮ম খণ্ড)

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আজকের দিনে ইসলাম ‘সন্ত্রাস ও রক্তপাতের ধর্ম’ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে এবং এক বৃহৎসংখ্যক জনগোষ্ঠী এটাকে প্রকৃতপক্ষে এমন এক ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করে, যে ধর্ম মানুষে মানুষে এবং জাতিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার বিস্তার ঘটায়। প্রকৃত ঘটনা হলো, ইসলাম হচ্ছে শান্তির সবচেয়ে বড় সমর্থক এবং পবিত্র নবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সব যুগের শান্তির সর্বশ্রেষ্ঠ সমর্থক, সমগ্র মানবজাতির জন্য শান্তির বাণী বিস্তারকারী।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পন্থায় শান্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করে। অনেক দেশে ‘ভালোবাসা সবার তরে ঘৃণা নয় কারও পরে’ এই স্লোগান সংবলিত পোস্টার-ব্যানার নিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর দৃশ্যও মিডিয়ার সুবাদে চোখে পড়ে। এই স্লোগানে আসলেই অত্যন্ত চমৎকার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। সবার জন্যই ভালোবাসা আর এই ভালোবাসা শুধু একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের জন্য নয় বরং ধর্ম-বর্ণ- গোষ্ঠী সবার জন্য।

আমরা সবাই যদি এই স্লোগানের আদলে নিজেদের জীবন পরিচালনা করতে পারতাম তাহলে সমাজ ও দেশে কোথাও হয়তো অশান্তি দেখা দিত না। যুক্তরাজ্যের মতো দেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আজ আওয়াজ তোলা হচ্ছে। আসলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আজ দলমত নির্বিশেষে সবার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সন্ত্রাস যে দলেরই হোক না কেন তা নির্মূলে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। কেননা, যারা ধর্মের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে তারা কোনোভাবেই ধার্মিক হতে পারে না, তারা সন্ত্রাসী। ধর্ম একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। যার যার ধর্ম সে পালন করবে, এতে বাধ সাধার কারও অনুমতি নেই।

সমগ্র বিশ্বের সব মানুষই তাদের নিজ ধর্ম-পছন্দ করতে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন, তারা যে ধর্মই পছন্দ করবে, যে ধর্মের আজ্ঞানুবর্তী হয়ে তারা সুখী হবে, সে ধর্মই তারা প্রতিপালন করবে। পৃথিবীর বুকে এমন ব্যক্তি নেই, যে কোনোভাবে কাউকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করবে অথবা সেজন্য শক্তি প্রয়োগ করবে। পবিত্র কোরআনই এ ঘোষণা দেয় যে, বিশ্বাসের স্বাধীনতা হচ্ছে সব মানুষের মৌলিক অধিকার। পছন্দমাফিক যেকোনো ধর্মেই তারা বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে এবং তাদের পছন্দ মোতাবেক তারা যে কোনো ধর্মেরই আজ্ঞাবাহী সদস্য হতে পারে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘এবং বল, এটা হচ্ছে তোমার প্রভুর কাছ থেকে আগত সত্য, সে কারণে যে চায়, এতে বিশ্বাস করুক এবং যে চায়, অবিশ্বাস করুক।’ (১৮ : ২৯) ইসলাম হচ্ছে এক সুস্পষ্ট সত্য, যারা এতে বিশ্বাস করতে পছন্দ করে, তাদের তা করতে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং যারা এতে বিশ্বাস করতে চায় না, তাদের সেটা অগ্রাহ্য করারও পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। ধর্মের বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটাকে পছন্দ করার ব্যাপারে মানুষকে স্বাধীনতা দান করা হয়েছে। ইসলামের এমন কোনো অস্ত্র নেই, যা দিয়ে কোনো মানুষকে জবরদস্তি করে ধর্মান্তরিত করা যায়।

অন্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে আচরণের বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা নিয়ে অন্য আরেকটি প্রশ্ন অনেকের মনে পীড়া দেয়। ইসলাম কি মুসলমানদের অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ঘৃণা করতে না’কি সম্মান ও দয়া প্রদর্শন করতে শিক্ষা দেয়? এ বিষয়ের ওপর পবিত্র কোরআন প্রচুর পথনির্দেশনা দান করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘বল, হে আহলে কিতাব! আমাদের এবং তোমাদের মধ্যে সমশিক্ষাপূর্ণ একটি নির্দেশের দিকে এসো-যা হচ্ছে, আমরা কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করি, এবং আমরা তার সাথে আর কাউকেই শরিক করি না, এবং তাকে ছাড়া আমরা আর কাউকেই প্রভু-প্রতিপালক বলে মান্য করি না।’ (৩ : ৬৪)

একই বিষয়ে পবিত্র কুরআন আরও বর্ণনা করে, ‘এবং ন্যায়-পরায়ণতা ও ধার্মিকতায় পরস্পরকে সাহায্য কর, কিন্তু পাপ ও সীমালঙ্ঘণে পরস্পরকে সাহায্য করো না।’ (৫ : ২) ধর্মের কোনো উল্লেখ এখানে করা হয়নি। পবিত্র কুরআন বলে, তোমাদের উচিত, সর্বদাই প্রত্যেক সৎকর্ম ও মহৎ-উদ্দেশ্যের আহ্বানে যোগদান করা, সে আহ্বান যদি কোনো ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা যে কোনো ধর্মের অনুসারী, এমন কি নাস্তিকের তরফ থেকেও আসে, ইসলাম মুসলমানদেরকে এ ধরনের লোকদের আহ্বানে সাড়া দেয়া এবং তাদের সাথে সহযোগিতা করারও আবশ্যকতা বোধ করে। তাদের উচিত কেবল সেই কারণটির প্রতিই তাকানো, যে জন্য তাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, কে আহ্বান করছে, সেদিকে নয়।

ইসলাম সোনালী এক নীতি নির্ধারণ করেছে, যা সকল মানুষই অনুসরণ করতে সক্ষম এবং তা থেকে সবাই উপকৃত হতে পারে। ইসলাম এ শিক্ষা দান করে যে, সব আচরণের ভিত্তি সর্বদাই ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। পবিত্র কুরআন বর্ণনা করে, ‘হে যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহর ব্যাপারে স্থির সংকল্প হও, সাক্ষ্যদানে নিরপেক্ষতা বজায় রাখো, এবং মানুষের শত্রুতা যেন তোমাদের ন্যায়বিচারহীন কোনো কাজে প্ররোচিত না করে। সর্বদাই ন্যায়পরায়ণ হও, সেটাই হচ্ছে সততার অধিকতর নিকটবর্তী এবং আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আল্লাহ অবশ্যই অবগত আছেন।’ (৫ : ৮)

একথা এটাকে পর্যাপ্তভাবে খোলাসা করেছে, ইসলামের প্রকৃত অনুসারীদের ওপর এটা নির্ধারিত করা হয়েছে যে, শত্রুদের সাথেও তারা ন্যায্যতার নিরিখে আচরণ করবে। এমন একটি ধর্ম, যা ঐক্য ও সহযোগীতার অনুপম শিক্ষার বিস্তার ঘটায়, সেই ধর্মের এমন কোনো সম্ভাবনা আছে কি যে, অন্য লোকদের বিরুদ্ধে কখনো সহিংসতা অথবা ঘৃণার বিস্তার ঘটাবে? মানবজাতিকে দেয়া হেদায়াতের চূড়ান্ত-বাণী এবং মুক্তির সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপত্রই হলো ‘ইসলাম’, যেটা হচ্ছে- ভালোবাসা ও শান্তির একটি বার্তা, এবং সেটা কখনোই সন্ত্রাস অথবা যুদ্ধের কোনো বার্তা নয়।

একদল সন্ত্রাসী ও চরমপন্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে নৃশংসতা ও ভয়াবহতা সংঘটিত করে চলেছে, কোনোভাবেই তারা ইসলামের প্রতিনিধি নয়, তারা ইসলামের মানদণ্ড বহনকারী কেউ নয়। নিশ্চিত থাকুন, সেটাই হচ্ছে খাঁটি ইসলাম, আল্লাহর পরম বাক্য পবিত্র কুরআনের আইনসঙ্গত কর্তৃত্বের সীলমোহর যেটা বহন করে এবং যা ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা পবিত্র নবী (সা.) এর কথা ও মহৎ অনুশীলনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এ ইসলাম শান্তি বই আর কিছুই নয়। আমাদের সবার স্লোগান হোক ‘ভালোবাসা সবার তরে ঘৃণা নয় কারো পরে’। ভালোবাসা দিবসে সবাইকে জানাই অন্তর থেকে আন্তরিক ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।

এইচআর/জিকেএস