ভাষাশহীদ আব্দুল জব্বার স্মরণে তার গ্রামের নাম ‘জব্বার নগর’ করার সিদ্ধান্ত ২০০৭ সালের। দীর্ঘ ১৬ বছর পার হলেও এ ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি। কেন হয়নি তাও জানে না জেলা প্রশাসন। গ্রামের প্রবেশদ্বারে একটি তোরণ নির্মাণ করেই দায় সেরেছে জেলা পরিষদ। স্থানীয়দের দাবি, ভাষা আন্দোলন ও জব্বারের স্মৃতি ধরে রাখতে এই নামের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রয়োজন।
গফরগাঁও উপজেলা সদরে যাওয়ার আগে রাওনা বাজার মোড়ের ডানপাশে বড় তোরণ জানান দেয় এটা জব্বার নগর। সেখান থেকে দু’তিন কিলোমিটার ভিতরে ঢুকলেই ভাষাশহীদ জব্বারের বাড়ি।
এই ভাষাশহীদের জন্মভিটায় জব্বার স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে ওই পাঠাগার চলে। ভাষার মাসের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে তেমন দর্শনার্থী আসে না বলেই জানান প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক। ২০০৮ সালে এই কমপ্লেক্সটি উদ্বোধন করেন ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন, ড. হালিমা খাতুন ও রওশন আরা বাচ্চু।
প্রতিষ্ঠানটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সামনে মাঠ। মাঠের একপাশে একটি প্রাইমারি স্কুল। শহীদ জব্বারের নামেই এর নাম। মাঠের উত্তর পাশে রয়েছে একটি শহীদ মিনার। সেখান থেকে একটু পিছে জব্বারের বাড়ি। তবে বাড়িটি আছে অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায়। জব্বারের বংশধর এক শিশুকে পাওয়া গেলেও ‘এখানে কেউ থাকে না’ ছাড়া আর কিছু বলতে পারেনি।
জাদুঘরের ভিতরে ঢুকে দেখা যায়, ঘরজুড়ে বেশ কয়েকটি আলমারি। সবগুলো বইয়ে ঠাঁসা। পাঠক যে খুব বেশি আসে না বইয়ের ভাঁজ দেখেই বলে দেওয়া যায়। জাদুঘর বললেও সেখানে শহীদ জব্বারের কোনো স্মৃতি সংরক্ষণে নেই।
আমরা ঘুরে দেখতে দেখতেই সেখানে এলেন জব্বারের দূর সম্পর্কের একজন ভাই। বয়স ৬০ এর বেশি। তিনি বলেন, আমার ভাইয়েরা যদি তখন জীবন না দিতো তাহলে আমাদের তো উর্দু ভাষায় কথা বলতে হবে। আমরা জন্মের পর থেকেই তার কথা শুনি। এখানে তার একেবারে কাছের কেউ থাকে না। জন্মভিটাটা রয়েছে। তবে তার কথা মনে হলে খুব খারাপ লাগে। সে আমাদের গর্ব, দেশের গর্ব।
জানা যায়, ভাষাশহীদ আব্দুল জব্বারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার জন্মস্থান পাঁচুয়া গ্রামের নাম জব্বার নগর করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৭ সালের ২৫ মার্চ স্থানীয় সরকার বিভাগের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়। দীর্ঘ ১৬ বছরে এর বাস্তবায়ন হয়নি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, অফিসিয়াল কাগজে পাঁচুয়া নামটাই রয়ে গেছে। যার কারণে তোরণে বা আমাদের হৃদয়ে জব্বার নগর থাকলেও বাস্তবে নেই। নতুন প্রজন্ম পাঁচুয়াই জেনে বড় হচ্ছে।
এ বিষয়ে কথা হয় ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ পাঠানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সেখানে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে পাঠাগার করেছি। সেটা জব্বারের নামেই। আমার স্টাফও আছে সেখানে। জব্বার নগর নামের বিষয়ে আমি জানি না।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলার সময়- উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘জব্বার নগর এখনো অফিসিয়ালি কার্যকর হয়নি?’ এলাকাবাসী বলছে- এখনো কার্যকর হয়নি। আপনার কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য আছে কি না, জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘না। আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। আপনি গফরগাঁও এর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। ওরা জানবে।’
এ বিষয়ে গফরগাঁও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবিদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন আসছি। ১০ তারিখে জয়েন করেছি। এগুলো এখনো খোঁজ নিয়ে দেখিনি। আমি খোঁজ নিয়ে দেখি। তবে আমি জানি যে, এটা জব্বার নগর।’
এ বিষয়ে রাওনা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মো. বাবুল জাগো নিউজকে বলেন, তোরণে লেখা জব্বার নগর। অথচ কাগজে কলমে পাঁচুয়া রয়ে গেছে। এলাকাবাসীসহ আমাদের দাবি- বইপুস্তক ও অফিসিয়াল কাগজে লেখা হোক জব্বার নগর। তাহলে সবাই এই নামেই চিনবে।
ভাষাশহীদ আবদুল জব্বার জন্ম ১৯১৯ সালের ১০ অক্টোবর ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামে। তার বাবার নাম হাসান আলী এবং মায়ের নাম সাফাতুন নেছা।
আবদুল জব্বারের পুত্র জন্ম হওয়ার কিছুকাল পরে তার শাশুড়ি ক্যানসারে আক্রান্ত হন। শাশুড়িকে নিয়ে ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। হাসপাতালে তার শাশুড়িকে ভর্তি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রদের আবাসস্থল (ছাত্র ব্যারাক) গফরগাঁও নিবাসী হুরমত আলীর রুমে (২০/৮) ওঠেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে এলে জব্বার তাতে যোগ দেন।
এসময় আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে এবং জব্বার গুলিবিদ্ধ হন। ছাত্ররা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে যারা হাসপাতালে নিয়ে যান, তাদের মধ্যে ছিলেন ২০/৯ নম্বর কক্ষের সিরাজুল হক। তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত দেওয়া হয়।
মহান ভাষা আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকা রাখায় আবদুল জব্বারকে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) দেয়।
এসইউজে/এএ/জিকেএস