নীলফামারী সদরে সোনারায় ইউনিয়নের দারোয়ানী শাহপাড়া গ্রামে প্রায় একমাস আগে ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হন ইপিজেডের চার নারী শ্রমিক। ট্রেন দুর্ঘটনায় এত মানুষের মৃত্যু মনে দাগ কেটেছে ওই গ্রামের বাসিন্দা আলমগীর হোসেনের (৪৮)। তাই বাঁশ দিয়ে রেলক্রসিংয়ের দুপাশেই ব্যারিকেডের ব্যবস্থা করেন তিনি। প্রতিদিন ট্রেন আসার আগে ব্যারিকেড দিয়ে রেলক্রসিংহ পাহারা দেন আলমগীর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আলমগীর হোসেন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। পড়াশোনা একদমই করেননি। বাবার কাছ থেকে পাওয়া জমিতে ঘর করে বসবাস করেন স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে। একটি ভ্যান আর রেললাইনের ধারে ছোট্ট একটি চায়ের দোকানই তাদের একমাত্র অবলম্বন।
টাকার অভাবে নিজে পড়তে না পারলেও শত কষ্টের মধ্যেও সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। বড় ছেলে আমিনুর রহমান ও ছোট ছেলে দিনার আলম এবার এসএসসি পাস করে একটি মাদরাসায় আলিমে ভর্তি হয়েছে। ছোট মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম (৪৫) চায়ের দোকান করেন। আলমগীর ভ্যান চালিয়ে যা আয় করেন তা দিয়েই চলে সংসার।
চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি দারোয়ানী রেলস্টেশনের শাহপাড়া গ্রামে রেলক্রসিংয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে ট্রেনের ধাক্কায় ইজিবাইকের চার নারী চোখের সামনেই নিহত হন। নিহতরা সবাই উত্তরা ইপিজেডের নারী শ্রমিক। এ সময় চালকসহ আহত হন আরও পাঁচজন। চোখের সামনে এমন দুর্ঘটনা দেখে ভ্যানচালক আলমগীরের মনে দাগ কাটে। আর যেন কেউ ট্রেনে কাটা না পড়ে সেই চিন্তা থেকে ২৭ জানুয়ারি রেলক্রসিংয়ের দায়িত্ব নেন তিনি।
স্টেশনের ধারে বাড়ি হওয়ায় ট্রেন আসার সময় তার মুখস্থ। তাই ট্রেন আসার আগে রেলক্রসিংয়ের দুদিকে বাঁশ বেঁধে রেলক্রসিং বন্ধ করে রাখেন। তার হাতে থাকা কলাপাতার পতাকা দিয়ে ট্রেন সিগন্যাল দেন। তার এমন দায়িত্ব পালনে সন্তুষ্ট নিজের পরিবার ও এলাকার মানুষ।
আলমগীর বলেন, ‘চোখের সামনে ট্রেনের ধাক্কায় ইজিবাইকে থাকা উত্তরা ইপিজেডের চার নারী শ্রমিক একসঙ্গে মারা গেলো। সেই দৃশ্য দেখার পর থেকে নিজেকে আমি ঠিক রাখতে পারিনি। তাই নিজের ছোট বাঁশঝাড় থেকে দুটি বাঁশ কেটে পরদিন ভোরে ক্রসিংয়ের দুপাশ বন্ধ করার ব্যবস্থা করি। ট্রেন আসার আগেই বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাখি।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাতোত ঘড়ি নাইতা কি হইছে, লাইনের ধারত বাড়ি, যেইঠে থাকোনা কেন ট্রেনের হুইসেল পাইলে হাজির হও রেলগেটোত। ওইটা শুনিয়া মুই বাঁশ দিয়া গেট বন্ধ করো। ট্রেন যাওয়ার পর খুলি দেও। এলাকার মানুষ ভালোই কয়। এতে কারও কোনো আপত্তি নাই।’
আলমগীর বলেন, ‘সবার উচিত সরকারকে সহযোগিতা করা। আমাদের দেশে অসংখ্য খোলামেলা রেলক্রসিং আছে। এসব রেলক্রসিং পারাপারে এলাকার মানুষ দায়িত্ব পালন করলে রক্ষা পাবে অনেক জীবন। মানুষকে ভালোবেসে নিজের ইচ্ছায় এসব কাজ করা দরকার।’
স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম বলেন, ‘মোর স্বামী রেলগেটের পাহারাত যেয়া ভ্যানের ভাড়া নিয়া শহরোত যাবার পারে না। এতে কিছুটা কামাই (আয়) কমেছে। এজন্য ছেলেদের নিয়ে বাড়ির কাজের পাশাপাশি লাইনের ধারোত চায়ের দোকান করি।’
বড় ছেলে আমিনুল ইসলাম (১৯) বলেন, ‘বাবাতো ভালোর জন্য কাজ করছেন, এজন্য আমাদের কষ্ট হলেও মেনে নিচ্ছি। বরং একাজে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।’
সোনারায় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম শাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওই গেটটি যেন মরণফাঁদ। নিঃসন্দেহে আলমগীরের এটি একটি মানবিক কাজ। তার মতো একজন ভ্যানচালক নিজের ইচ্ছায় কাজটি করায় সমাজের উদাহরণ দাঁড়িয়েছে। এজন্য পরিষদের পক্ষে সার্বিক সহযোগিতা থাকবে তার জন্য।
স্থানীয় সেফউল ও আব্দুস সোবহান বলেন, আলমগীর যেভাবে কাজ করছে সেটা অভাবনীয় একটি কাজ। আমরা এলাকাবাসী তার এই মহৎ কাজ নিয়ে গর্ববোধ করি। আমরা চাই এখানে একটি রেলগেট নির্মাণ হোক। আর এই গেটে গেটম্যান হিসেবে আলমগীরকেই নিয়োগ দেওয়া হোক।
নীলফামারী স্টেশনমাস্টার ওবায়দুল রহমান রতন জাগো নিউজকে বলেন, ওই রেলক্রসিং অতিক্রম করে চিলাহাটি থেকে রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা পর্যন্ত প্রতিদিন ট্রেন চলাচল করে ১২টি। দুর্ঘটনা রোধে দারোয়ানী স্টেশনের কাছে অরক্ষিত একটি রেলগেটে আলমগীর নামের এক ব্যক্তির দায়িত্ব পালনের কথা শুনেছি। তিনি নিজ দায়িত্বে সে কাজটি করছেন। এটি একটি ভালো কাজ।
সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহিদ মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, এটি নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। তার ওই দায়িত্ব পালনে গেটের দুই পাশের সড়কে আরসিসি পিলারের জন্য আবেদন করেছেন এলাকার মানুষ। সেটি উপজেলা পরিষদ থেকে দেওয়া হবে। এছাড়া তিনি নিন্মআয়ের একজন মানুষ, তার পরিবার রয়েছে। এজন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচি থেকে তাকে নিয়মিত সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে।
এসজে/জিকেএস