দেশজুড়ে

দিনাজপুরের ৫০ ইউনিয়নে সুপেয় পানির তীব্র সংকট

শুষ্ক মৌসুম যেন দিনাজপুরবাসীর জন্য বয়ে আনে সীমাহীন কষ্ট! চৈত্র-বৈশাখ মাস এলেই জেলার অন্তত ৫০টি ইউনিয়নে দেখা দেয় সুপেয় পানির তীব্র সংকট। প্রতি বছর ভুক্তভোগী ইউনিয়নের এ সংখ্যা বাড়ছে। ইরি-বোরো ধান চাষ শুরু হলেই পানির চাহিদা বেড়ে যায়। তখন টিউবওয়েল থেকে সুপেয় পানি মেলে না। সংকট নিরসনে সরকারিভাবে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু টিউবওয়েল বসালে তাতেও মিলছে না সুফল। সুপেয় পানির জন্য তাই ছুটতে হয় কয়েক কিলোমিটার দূরে। এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় বর্ষা মৌসুমের আগ পর্যন্ত।

দিনাজপুরে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, খরা মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্থিতিতল ২৫ ফুটের নিচে নেমে গেলে টিউবওয়েলে পানি তোলা সম্ভব নয়। প্রতি বছরই স্থানভেদে পানির এই স্থিতিতল গড়ে প্রায় এক মিটার করে নেমে যাচ্ছে। জেলার ১০২টি ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় ৫০টি ইউনিয়নে খরা মৌসুমে এ সমস্যা দেখা দেয়।

আরও জানা যায়, এ সমস্যা সমাধানে ২০২০ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জেলার ১০২টি ইউনিয়নে ৩ হাজার ১৫০টি টিউবওয়েল (তারাপাম্প) বসায়। একইভাবে ২০২১ সালে বসানো হয় ২ হাজার ৬৭৮টি টিউবওয়েল। চলতি বছরও টিউবওয়েল বসানোর প্রক্রিয়া চলমান।

দিনাজপুর চিরিরবন্দর উপজেলার ৭ নম্বর আউলিয়াপুকুর ইউনিয়নের মাঝিনা গ্রাম। গ্রামটির ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বাগানপাড়া নামে একটি আদিবাসীপল্লি রয়েছে। ৩৬টি বাড়ি নিয়ে প্রায় দেড়শ লোকের বসবাস এই পল্লিতে। প্রতি বছরই ইরি-বোরো মৌসুম অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু করে জুন মাস পর্যন্ত এই পল্লির মানুষের মধ্যে থাকে পানির জন্য হাহাকার। অনেকেরই সকাল-সন্ধ্যায় প্রায় দেড় কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি নিয়ে আসতে হয়।

সেখানে বসবাসরত লিমা মুর্মু জাগো নিউজকে বলেন, খরা মৌসুমে যখন চারদিকে ইরি-বোরো ধান চাষাবাদ হয় তখন আমাদের এখানকার টিউবওয়েল থেকে পানি উঠতে চায় না। অনেক দূর থেকে পানি আনতে হয়। এই কষ্ট কেবল আমরাই বুঝি। সরকার থেকে এই টিউবওয়েল (তারাপাম্প) দিয়েছে। এতে পানি তুলতে অনেক সময় লাগে। হাঁপিয়ে যেতে হয়। পানি ওঠে সামান্য।

পানির এ সমস্যা কৃষিতে সেচের ক্ষেত্রেও। কৃষকরা বলছেন, পানির স্থিতিতল নেমে যাওয়ায় ফসলি জমিতে সেচের অভাব ও সময় দুই-ই বেড়েছে। এতে একদিকে যেমন বাড়ছে উৎপাদন খরচ, অন্যদিকে সেচের অভাবে কমছে উৎপাদন।

মিনতি মুর্মু নামে এক গৃহিণী বলেন, চৈত্র মাসে যখন ইরি-বোরো ধানের আবাদ হয় তখন আমাদের পানির কষ্ট বেড়ে যায়। চারদিকে ডিপ (গভীর নলকূপ) চলে, আর আমরা পানি পাই না। এখানে সরকার থেকে একটা টিউবওয়েল দিয়েছে, তাতেও পানি ওঠে অনেক দেরিতে। তাই অনেক দূর থেকে পানি আনতে হয়।

একই এলাকার বিউটি মুর্মু নামে এক গৃহিণী বলেন, আমাদের এখানে পানির খুব কষ্ট। আবাদি জমিতে পানি বেশি লাগে। তাই আমরা পানি পাই না। ফ্লাগুন-চৈত্র মাসে এই সমস্যা বেশি দেখা দেয়।

ইন্দ্রপাড়া এলাকার মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছর চিরিরবন্দরে পানির সংকট দেখা দেয়। ফ্লাগুন-চৈত্র মাসে শুরু হয় এই সংকট। যতদিন না আকাশের পানি হবে ততদিন এ সমস্যা। এখন অনেকেই সাবমার্সেবল (মাটির নিচে থাকা পাম্প) বসিয়েছে। আমি বসাতে পারিনি। মানুষের বাড়িতে পানি আনতে গেলে অনেক কথা শুনতে হয়।

মাঝিনা এলাকার কৃষক জয়নাল হোসেন বলেন, আমাদের এখানে ডিপেও (গভীর নলকূপ) ভালোমতো পানি ওঠে না। যেভাবে সেচ দেওয়া দরকার সেভাবে পাই না। এক ঘণ্টায় যেখানে পানি দেওয়া হয়ে যায় সেখানে দুই ঘণ্টা লাগে। এতে দেখা যায় ফলনও কম হয়। যেখানে বিঘায় ৩০ মণ ফলন হতো সেখানে ফলন ২০ থেকে ২৫ মণ হয়। এদিকে সার-বিষের খরচ তো বাদই দিলাম। প্রতি বছরই একই সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

বীরগঞ্জ উপজেলার ৭ নম্বর মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের সাধন চন্দ্র রায় বলেন, টিউবওয়েলগুলোতে পানি ওঠে না। গর্ত করে শ্যালোমেশিন নিচে নামানো হয়েছে। প্রতি বছর এই মৌসুমে গোসল করা, খাবার পানি ও গৃহস্থালি কাজের পানি নিয়ে সংকট তৈরি হয়।

একই অবস্থা বিরাজ করছে কাহারোল, বিরল ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। সদরের ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ছয়টি ইউনিয়নেই বিশুদ্ধ পানির সংকট চলছে। মানুষ পানির জন্য কুয়ার মতো বড় বড় গর্ত খুঁড়ে ডিজেলচালিত শ্যালোমেশিন, বিদ্যুৎচালিত মোটর নিচে নামিয়েছে। তারপরও পানি উঠছে না। যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে দিনাজপুরের বোরো আবাদও ব্যাহত হতে পারে।

বীরগঞ্জ উপজেলার ৭ নম্বর মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোপাল দেব শর্মা জাগো নিউজকে বলেন, এর আগে লক্ষ্মীপুর গ্রামের সাত জায়গায় বোরিং করেও পানি পাওয়া যায়নি। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছে। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের নজরে রয়েছে।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী এ এন নাইমূল এহসান জাগো নিউজকে বলেন, বিভিন্ন কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্থিতিতল নেমে যাচ্ছে। প্রতি বছরই স্থানভেদে পানির এই স্থিতিতল গড়ে প্রায় এক মিটার করে নামছে। এর মধ্যে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাব, ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর অধিক নির্ভরতা এবং ভূ-উপরস্থ পানির স্বল্পতাসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে। পানির এমন সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার টিউবওয়েল বসানো, নদী খননসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।

এএ/জিকেএস