দেশজুড়ে

পানামা রোগে মরছে কলাগাছ, লোকসানে হাজারো কৃষক

কলা গাছে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে পানামা রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েকশ’ হেক্টর জমির কলা গাছ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ আতঙ্কে কলা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন টাঙ্গাইলের মধুপুর, ঘাটাইল, সখীপুর ও মির্জাপুর উপজেলার হাজারো কৃষক।

স্থানীয় কলাচাষিদের কাছে পানামা রোগ একটি ‘অজ্ঞাত ভাইরাস’। এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে কলা গাছের পাতা হলুদ হয়। পরে ধীরে ধীরে গাছ নিস্তেজ হয়ে মারা যায়। প্রথমে দু-চারটি গাছ আক্রান্ত হলেও কয়েকদিনের মধ্যে পুরো বাগানে ছড়িয়ে পড়ে এ রোগ। দুই বছর ধরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। লোকসানে পড়ে অনেকে আবাদ বন্ধ করে দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লাল-ধুসর মাটি কলা চাষের জন্য বেশ উপযোগী। মাটির উর্বরতার পাশাপাশি অনুকূল আবহাওয়া কলার উৎপাদন আরও বাড়িয়ে তোলে। মধুপুর গড়াঞ্চলের মধুপুর, ঘাটাইল, সখীপুর, মির্জাপুর উপজেলার অধিকাংশ কৃষক আনারসের সাথী ফসল হিসেবে কলা চাষ ছিল নিয়মিত অনুষঙ্গ। কম খরচ ও স্বল্প শ্রমের কলা চাষে লাভের মুখ দেখেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। এতে অনেকে স্বাবলম্বীও হয়েছেন।

এছাড়া কলা গাছের পরিত্যক্ত অংশ দিয়ে স্থানীয় কারখানায় সুতা ও শো-পিচ তৈরি করা হচ্ছে। হঠাৎ পানামার আক্রমণে অপার সম্ভাবনাময় কলাচাষে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে অনাগ্রহ সৃষ্টি করেছে।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর শুধুমাত্র মধুপুর উপজেলায় ১০ হাজার একর জমিতে কলা চাষ হলেও এবার মাত্র ৭ হাজার একর জমিতে কলা চাষ করা হয়েছে।

কৃষি বিভাগ জানায়, রোগমুক্ত মাঠ থেকে চারা সংগ্রহ, মাঠ থেকে রোগাক্রান্ত গাছ পুড়িয়ে ফেলা, রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করা, রোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয় এমন ফসল সাথী ফসল হিসেবে চাষ না করা, দু-তিন বছর পর ফসল বদল করে শস্য পর্যায় অবলম্বন করা, চুন প্রয়োগ করে মাটির জৈব শক্তি বাড়ালে পানামা রোগ থেকে কলাগাছ মুক্ত রাখা যেতে পারে।

স্থানীয় কলা চাষিরা জানান, প্রতি বিঘা জমিতে ৩৫০ থেকে ৩৮০টি কলা গাছ রোপণ করা হয়। একটি কলা গাছে রোপণ থেকে বাজারজাত পর্যন্ত ১২০ থেকে ১৯০ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি কলার ছড়ি ৩২০ থেকে ৪৩০ টাকায় বিক্রি করা যায়। এ হিসেবে প্রতি বিঘায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা কৃষকের লাভ হয়। এ অঞ্চলে বারিকলা-১ ও বারিকলা-২ (আনাজিকলা), অমৃতসাগর, মন্দিরা, মন্দিরা সাগর, সবরি, চম্পা, চিনিচাম্পা, কবরি, মেহেরসাগর, বীচিকলা ইত্যাদি জাতের কলা চাষ হয়ে থাকে।

পুষ্টিকর ফল কলা চাষে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্য জেলাগুলোতে রপ্তানি করা যেত। পানামা রোগের কারণে বর্তমানে কলা চাষের প্রতি কৃষকরা ক্রমশ অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। চাষও দিন দিন কমে যাচ্ছে।

মধুপুর উপজেলার শোলাকুড়ির ধরংপাড় গ্রামের কলা চাষি শামীম মিয়া, নায়েব আলী, হরিণধরার আ. রশিদ, সোহাগ হোসেন, ফকিরাকুড়ির আনোয়ার হোসেন আনু, নওগাঁইলের খোকন মিয়া, লটপাড়ার শফিকুল ইসলাম, হাগুরাকুড়ির আনোয়ার হোসেন আলম, চাঁনপুর গ্রামের আবুল কালাম, হাফিজুর রহমানসহ অনেকেই জানান, তাদের প্রধান ফসল আনারস। সাথী ফসল হিসেবে তারা কলা চাষ শুরু করেন। কয়েক বছর ভালো ফলন পেলেও গত দু বছর ধরে কলাগাছে পানামা রোগ দেখা দেওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই আগের চেয়ে কলা চাষ কম করছেন।

তারা আরও জানান, মধুপুর বনাঞ্চলের জমিতে চাষাবাদ করার কারণে তারা ব্যাংক ঋণও পান না। ছয়-সাত বছর আগে কলা চাষে লাভ হলেও ক্রমান্বয়ে লোকসান হওয়ায় অনেকেই পুঁজি হারিয়েছে। এরপরও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কলা চাষ করে ফের লোকসান গুনেছেন চাষিরা। অনেকে আবাদ বন্ধ করে দিয়েছেন।

মধুপুর কলা চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান মিন্টু জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সংগঠনের সদস্যদের লাখ লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছেন চাষিরা। লোকসানের মুখে পড়ে ও পুঁজির অভাবে এ বছর অনেকে কলা চাষ করেননি। তিনি আরও বলেন, কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও প্রচেষ্টা তাদের কোনো কাজে আসেনি। পানামা রোগে এ অঞ্চলের কৃষকদের ৫-৭ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এই রোগে বাগানের পর বাগান বিনষ্ট হয়েছে।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, পানামা একটি প্রাচীন ও ফাঙ্গাস জাতীয় রোগ। এটি কোন ভাইরাস নয় আর রোগটি নিরাময়যোগ্য। মধুপুর ফলজ অঞ্চল হিসেবে কৃষি বিভাগের কর্মীরা সরাসরি মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন। মূলত একই জমিতে বার বার কলা চাষ করায় মাটির জৈব উপাদান কমে যাচ্ছে। ফলে ফসল উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এছাড়া অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার, ভালো বীজ বা চারা সংগ্রহ না করায় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষি বিভাগ মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সঠিক পরামর্শ, জৈবসার ব্যবহার ও কলা চাষে ফুডব্যাগিং পদ্ধতিতে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কাজ করছে।

আরিফ উর রহমান টগর/এসজে/জিকেএস