দেশজুড়ে

সোনার ধান বাঁচাতে হাওরে বাঁধ রক্ষার লড়াই

কেউ স্বপ্ন দেখেছিলেন বৈশাখে নতুন ধান ঘরে তুলে সারা বছর চালাবেন, আবার কেউ স্বপ্ন দেখেছিলেন ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দেবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন যেন অধরাই থেকে গেলো। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে একদিকে বাঁধ ভেঙে ডুবছে হাওর অন্যদিকে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে একমাত্র ফসল। তাই হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রক্ষায় দিনরাত লড়াই করছেন কৃষকরা।

কৃষকদের দাবি, ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জের সদর, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, দিরাই, শাল্লা ও ছাতক উপজেলার ছোট-বড় ১২টি হাওরের বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে প্রায় ৮ হাজার হেক্টরের মতো বোরো ধান। সেই ধান হারিয়ে নিঃস্বপ্রায় কয়েক হাজার কৃষক।

তবে জেলা কৃষি অফিসের দাবি, ১২ বাঁধ ভেঙে ৫ হাজার ১০ হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে গেছে।

জানা যায়, এ বছর সুনামগঞ্জের ১৫৪টি ছোট বড় হাওরের ২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষাবাদ করে ১৩ লাখ ৫২ হাজার ২২০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।আর সেই ধান যাতে কৃষকরা ঘরে তুলতে পারে সেজন্য সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় ৭২৪টি পিআইসির মাধ্যমে প্রায় ১২১ কোটি টাকার নতুন ও পুরাতন ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ হয়েছে। কিন্তু সরকারের এতো টাকা বরাদ্দ দিয়েও স্বপ্নের ফসল ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষক। বরং যে হাওরগুলো এখনও পানিতে তলায়নি সেগুলোর বাঁধ দিনরাত পাহারা দিচ্ছেন কৃষকরা। বাড়িঘর ছেড়ে বাঁধের ওপর বালুভর্তি বস্তা নিয়ে বসে আছেন তারা।

কৃষকরা বলেন, বাড়ি ঘর ছেড়ে এখন আমাদের দিনরাত বাঁধের ওপর বসে থাকতে হচ্ছে। বাঁধ আর কষ্টের ফসল পাহারা দিচ্ছি। পানি একটু ধাক্কা দিলেই বাঁধের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরে হাওরে পানি ঢুকে যায়।

তারা আরো বলেন, মনের ভেতর আতঙ্ক ঢুকে গেছে, যদি ফসল তলিয়ে যায় তাহলে না খেয়ে মরতে হবে। সরকারের দেওয়া শত কোটি টাকার বাঁধ যদি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে নির্মাণ করা হতো তাহলে হয়ত আজ আমাদের এতটা দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কে থাকতে হতো না।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওরের কৃষক লাল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছর বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওরের কৃষক সুফি মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, বাঁধ যখন নির্মাণ করা হয় তখন অনিয়ম করলে আমরা কৃষকরা প্রতিবাদ করি। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনে না। বরং সরকারি কাজে বাঁধা দিলে আমাদের নামে মামলা করার হুমকি দেয়। অথচ পিআইসিদের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে আজ ফসলরক্ষা বাঁধগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে রাত দিন আমরা বাঁধ টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে ব্যস্ত।

চন্দ্র সোনার থাল হাওরের কৃষক মকবুল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, বাঁধ নির্মাণ করা হয় কৃষকদের ফসল রক্ষা করার জন্য। কিন্তু সামান্য পানি এলেই যাদি সেই বাঁধ ভেঙে যায় তাহলে আমি মনে করি এই রকম বাঁধ নির্মাণ করার চেয়ে না করাই ভালো।

চন্দ্র সোনার থাল হাওরের কৃষক দিলোয়ার মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, সুনামগঞ্জে ১২টি হাওরের বাঁধ ভেঙে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে গেছে। অথচ কৃষি বিভাগ বলছে মাত্র ৫ হাজার হেক্টর। এখানেও তারা দুর্নীতি করছে।

মাটিয়ান হাওরের কৃষক জামান মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, বৃষ্টি হলেই কলিজা কাঁপে। এই বুঝি বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে গেলো। রাত হলে বাসায় না ঘুমিয়ে বাঁধে ঘুমাতে হচ্ছে কৃষকদের।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জাগো নিউজকে বলেন, হাওরের ৫ হাজার ১০ হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে গেছে। আমরা কৃষকদের দ্রুত ধান কাটতে পরামর্শ দিচ্ছি।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বাঁধ রক্ষায় আমরা সার্বক্ষণিক মাঠে আছি। ঝুঁকিপূর্ণ যে বাঁধগুলো আছে সেখানে আমাদের লোক আছে। আশা করি বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে বাঁধের তেমন ক্ষতি হবে না।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। দল মত নির্বিশেষে আমাদের একটি মাত্র বোরো ফসল রক্ষায় আমরা একযোগে কাজ করবো, সেই আহ্বান জানাচ্ছি সকলকে।

এফএ/জিকেএস