ধর্ম

রমজানে স্বস্তি মেলে ফিলিস্তিনে

মুসলিম বিশ্বের মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাস ঘিরে নানা অনুষ্ঠান আর রীতি-রেওয়াজ আছে। রোজা রাখা, ইফতারের পর তারাবির নামাজ পড়া ইত্যাদি ছাড়াও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খুশির আমেজ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়েও এসব রীতি সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। মধ্যপ্রাচ্য বা আরবের প্রাচীনতম একটি ভূখণ্ড ফিলিস্তিন। ইসলামের ইতিহাসের বিরাট জায়গা দখল করে আছে এই ফিলিস্তিন। কারণ, অসংখ্য নবী-রাসুলের স্মৃতিবিজড়িত এই ভূমিতে রয়েছে মুসলিম উম্মাহর প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাস বা আল আকসা। এক সময় ফিলিস্তিন ভূখণ্ড বলতে তৎকালীন বিশ্বে প্রভাবশালী বিস্তৃত এক অঞ্চলকে বোঝালেও আজ তা প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে ইসরায়েলি আগ্রাসনে। আমেরিকা ও ব্রিটেনসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যক্ষ মদদে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হলে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল ত্বরান্বিত হয়। একসময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতিত ইহুদিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ তারাই নিজ ভূমে পরবাসী। সেখানে কীভাবে পালিত হয় রমজান, তা নিয়ে লিখেছেন মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ ফানুস উড়িয়ে রমজানকে স্বাগত মাত্র ৬ হাজার ২০ কিলোমিটার আয়তনের ভূমি আজকের ফিলিস্তিন। যার মধ্যে পশ্চিম তীরের আয়তন ৫ হাজার ৬৫৫ এবং গাজার আয়তন ৩৬৫ কিলোমিটার। প্রতিনিয়ত নিজেদের ভূমি, ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে ফিলিস্তিনের মুসলিমদের। শত সংগ্রামের মধ্যেও তারা রক্ষা করার চেষ্টা করছেন তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সাধারণত ফিলিস্তিন বলতেই ইসরায়েলের আগ্রাসন, হামলা, হত্যা, জুলুম, নিযার্তন, গ্রেপ্তার ইত্যাদি বিষয়গুলোই আলোচনা বা প্রচার হয়ে থাকে।

অথচ ফিলিস্তিনিদের জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব বিস্তার করে আছে তাদের নিজস্ব রমজান সংস্কৃতি। তাদের কাছে রমজান হলো, আধ্যাত্মিক সাধনা ও আপন প্রত্যয়ে বলিষ্ঠ হওয়ার মাস। এ জন্য দলবদ্ধভাবে রমজানের চাঁদ দেখা থেকে শুরু করে ঈদ উদযাপন পর্যন্ত গোটা মাসকে উৎসব হিসেবে পালন করেন তারা। নতুন চাঁদ দেখা দিলে ফিলিস্তিনি শিশুরা রঙিন বেলুন ও ফানুস নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে।

উল্লাস ও উচ্ছ্বাসে রমজান বরণবাহারি ফানুসে বর্ণিল হয় ফিলিস্তিনের আকাশ। সেখানকার অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের রেশ। মানুষ সম্মিলিত কণ্ঠে রমজানের বিভিন্ন সংগীত গায়। উচ্চ আওয়াজে দফ বাজানো হয়। উল্লাস ও উচ্ছ্বাসের মাধ্যমে রমজানকে বরণ করা ফিলিস্তিনের একটি প্রাচীনতম ঐতিহ্য।

মুসলমানদের প্রথম কেবলামুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান হলো, ফিলিস্তিন। মুসলমানদের প্রথম কেবলা ‘মসজিদুল আকসা’ এখানেই অবস্থিত। বহু নবী-রাসুলের জন্মস্থান এই ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনের বাইতুল মোকাদ্দাস মসজিদ থেকে রাসুল (সা.) মেরাজে গমন করেন। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমের সুরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি; যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।’

রমজানে আকসার প্রতি ভালোবাসাবর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জাতিগুলোর অন্যতম ফিলিস্তিনিরা। দীর্ঘদিন ধরে তারা নির্যাতিত হচ্ছে। এরপরও তারা নিজস্ব আবাসভূমির স্বপ্ন হারায়নি। তাদের সেই স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আল আকসা মসজিদ এবং ডোম অব রক (কুব্বাতুস সাখরা)। তবে এখানে দখলদার ইসরাইলিদের বিধিনিষেধের কারণে ফিলিস্তিনিরা ইচ্ছা করলেই আসতে পারে না। তবুও আল আকসা মসজিদের প্রতি তাদের ভালোবাসার কমতি নেই। রমজান এলে তাদের সেই ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়।

রমজান এলেই ইসরায়েলের প্রবণতাফিলিস্তিন মানব ইতিহাসের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কারণ, এটি ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি তিন ধর্মের মানুষের কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে স্বীকৃত। এ তিন ধর্মের লোকেরা একে তাদের আদি আবাসভূমি মনে করেন। তাই ফিলিস্তন পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু আজ সেই পবিত্র ভূমিতে চলছে নারকীয় তাণ্ডব। সেখানে দিনের পর দিন ইসরায়েলি বোমা ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে অগণিত ফিলিস্তিনির বুক। কবে এ রক্ত বন্যা থামবে, তা কেউ জানে না। ইউরোপের দেশগুলো মুখ ঘুরিয়ে রাখে নিজেদের স্বার্থে আর মুসলিম দেশগুলো শুধু নিন্দাজ্ঞাপন করে দায় সারে। রমজান এলেই এই প্রবণতা বাড়তে থাকে।

মুক্তি সংগ্রামের প্রয়াস রমজানইসরাইলির নিষ্পেষণে থাকা ফিলিস্তিনি মুসলমানরাও সারা বিশ্বের মুসলমানদের সঙ্গে পবিত্র রমজান মাসের রোজা পালন করেন। তাদের মুক্তি সংগ্রামের একটি প্রয়াসও এই রমজান। সম্প্রতি মিডলইস্ট মনিটরে প্রকাশিত কিছু ছবিতে দেখা গেছে, আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের কুব্বাতুল সাখরার সামনে একদল স্কাউট ইফতারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরেক ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গাজার ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ইফতারের একটি জনপ্রিয় খাবার হুম্মা। এই রোজাতেও অনেকে এ খাবারটি দিয়েই ইফতার সারছেন। অন্য ছবিতে গাজায় কয়েকটি অন্ধ ফিলিস্তিনি বালিকাকে স্কুলে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে দেখা যাচ্ছে। আসলে এই তিনটি ছবি গোটা ফিলিস্তিনের চালচিত্র।

সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনাপবিত্র এ মাসে বিশ্ব মুসলিমের মতো ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ব্যাপক চর্চা করেন ফিলিস্তিনিরা। মসজিদগুলোতে দ্বীনের বিধি-বিধানের পাশাপাশি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য আলোচিত হয়। প্রতিটি পরিবারের শিশুরা বৃদ্ধদের কাছ থেকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার পরিবারের ত্যাগ ও কোরবানির ইতিহাস শোনে।

সেহরিতে জান্নাতি পাখির ডাকরমজানের মধ্যরাতে জেরুজালেমে ছেলে-মেয়েরা মিলে ড্রাম বাজিয়ে এবং চিৎকার করে ঘুম থেকে মানুষকে সেহরি খেতে জাগায়। এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। প্রযুক্তিগত বহু উন্নতি হলেও এটি একটি সম্মানিত ঐতিহ্য; যা আজও অব্যাহত রয়েছে। সেহরির সময়ে দলবেধে এমন মধুর চিৎকারে মনে হয়, যেন জান্নাতি পাখিরা ডাকছেন। মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এ প্রথা এখনও চালু রয়েছে।

ইফতারের সময়ের জানানজেরুজালেমে রমজানের কামান ছুঁড়ে ও আতশবাজি ফুটিয়ে ইফতারের সময় জানানো হয়। জেরুজালেমের বাসিন্দারা শত শত বছর ধরে রমজানের সময় কামানের গোলাগুলি শুনেছেন। জেরুজালেমের কামানটি শহরের মাঝখানে সালাহ আল দিন রাস্তায় আল সাহিরা গেট এলাকায় মুজাহিদিন ইসলামিক কবরস্থানে অবস্থিত। অন্যান্য শহর, যেমন কলকিল্যা, মসজিদে জামুর ইফতার (রোজার সাইরেন) ব্যবহার করে রোজা ভাঙার জন্য অবহিত করে।

সেহরি ও ইফতারে বিশেষ খাবাররমজানে বিশেষ বিশেষ খাবার তৈরি করতে পছন্দ করেন ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনিদের রমজানের রান্নায় অনেক খাবার রয়েছে, যার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে অন্যদের তুলনায় বিশেষ ধরনের পদ পছন্দ করা হয়। গাজায় সাধারণত মাকলুবা, সুমাগিয়াহ এবং মাফতউল খায়। পশ্চিম তীরে মুসাখান ও মনসাফ বিখ্যাত। আচার এবং সালাদ সবসময় ফিলিস্তিনি ইফতারের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। এখানকার ইফতারির সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশের বেশ মিল রয়েছে। পুরোনো জেরুজালেমের বাসিন্দারা চিরায়ত ঐতিহ্য অনুযায়ী তাদের জনপ্রিয় পানীয় তামারিন জুস পান করেন। তবে সাধারণত তাদের ইফতার প্রথমে খেজুর দিয়ে শুরু হয়। পনির ও দই জাতীয় খাবার ইত্যাদি সেহরিতে খায়।

খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সহায়তাপ্রতিবেশির খোঁজখবর নেওয়া এবং মুসলমানের সাহায্যে নিজের সর্বোচ্চ বিলিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টান্ত মেলা ভার। রমজানে তাদের এ প্রচেষ্টা শতগুণে বেড়ে যায়। অনেকেই সারা মাস মেহমানের সঙ্গে ইফতার করেন। সবার একান্ত চেষ্টা থাকে, কেউ যেন রোজার মাসে খাবারের কষ্ট না পায়। এ জন্য সম্মিলিত বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নানাভাবে তারা এ মাসে দরিদ্র মুসলমানদের বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সহায়তা করে থাকেন।

তারাবি ও তাহাজ্জুদে রাত পাররমজানের পুরো রাত জেগে থাকে ফিলিস্তিনের মসজিদগুলো। তারাবি ও তাহাজ্জুদে রাত কাটায় ফিলিস্তিনিরা। আর দিনগুলো মুখর থাকে ধর্মীয় আলোচনা ও ইতিহাস চর্চায়। ফিলিস্তিনিরা মসজিদে আকসায় তারাবির নামাজ পড়তে পছন্দ করে। ফিলিস্তিনের মসজিদগুলোতে দিনের বেলা ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা সভা হয়। এতে দ্বীনের বিধি-বিধানের পাশাপাশি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য আলোচিত হয়।

খাদ্য সংকট দূরীকরণঅবরুদ্ধ গাজাসহ পুরো ফিলিস্তিনে সারা বছর চরম খাদ্য সংকট থাকে। আরব মুসলিমরা রমজানে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের জন্য উপহার-উপঢৌকন, খাবার ও পানীয় পাঠায়। এতে রমজানে খাদ্য সংকট কিছুটা কমে যায়। পবিত্র রমজানেই অনেক ফিলিস্তিনি পেটপুরে খাওয়ার সুযোগ পায়। তাই জাগতিক বিচারেও রমজান ফিলিস্তিনের জন্য স্বস্তির বার্তা বয়ে আনে।

মুনশি/এসইউ/এমএস