২০১১ সালের ১১ জুলাই আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিনি ট্রাকযোগে খেলা দেখতে মিরসরাই স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন দুই ভাই সাদ্দাম হোসেন ও শাখাওয়াত হোসেন। শাখাওয়াত তখন ওই স্কুলের ষষ্ঠ ও সাদ্দাম অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। খেলা শেষে তারা বাড়ি ফেরার পথে বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কে সৈদালী এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের ডোবায় পড়ে যায় তাদের বহনকারী মিনি ট্রাক।
ডোবায় পানি কম ছিল। ট্রাকটি উল্টে সবার ওপরে পড়ে। এতে চোখ, মুখ ও নাকে কাদা ঢুকে মারা যায় ছাত্ররা। সেদিন জীবন-মরণ লড়াই করে বেঁচে ফিরেছিলেন কয়েকজন। তাদের মধ্যে রয়েছে সাদ্দাম হোসেনও। কিন্ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বড় ভাই মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এলেও ছোট্ট ডোবায় অন্যদের সঙ্গে মারা যায় ছোট ভাই শাখাওয়াত হোসেনের।
তাদের দুই ভাইকে এলাকায় ‘বড় মিয় ‘ ও ‘ছোট মিয়া’ বলে ডাকতেন। শাখাওয়াত হোসেন ও সাদ্দাম হোসেন ১১ নম্বর মঘাদিয়া ইউনিয়নের সরকারতালুক গ্রামের ওবায়দুল হকের ছেলে।
আজ ১১ জুলাই মিরসরাই ট্র্যাজেডির ১১ বছরে অন্যদের সঙ্গে ফুল দিয়ে নিহত ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানাতে ডোবায় নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ অন্তিম এ আসেন শাখাওয়াতের বৃদ্ধ বাবা ওবায়দুল হক। অন্তিমের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলেন তিনি। উপস্থিত লোকজনকে সাঁটানো ব্যানারে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, ‘শার্ট পরা ওই লাশটা আমার ছোট মিয়ার’।
‘আমার বড় মিয়া বেঁচে থাকলেও ছোট মিয়া বেঁচে নেই’ বলে কেঁদে ওঠেন বাবা ওবায়দুল হক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বড় ছেলে সাদ্দাম হোসেন প্রকাশ বড় মিয়া এখন নিজামপুর কলেজে অনার্সে পড়ছে। ছোট ছেলে বেঁচে থাকলেও কলেজে পড়তো। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আমার সুখের সংসার ছিলো। ১১ জুলাইয়ের ট্র্যাজেডি আমার একটি ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেদিন অন্যদের সঙ্গে আমার দুই ছেলেও খেলা দেখে বাড়ি ফিরছিল। আমি তখন বাড়িতে ছিলাম। হঠাৎ আমার ভাতিজা বললো, খেলা দেখতে যাওয়া ছাত্রদের বহন করা পিকআপ অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। খালি গায়ে বাড়ি থেকে দৌড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি অনেক মানুষের ভিড়। অনেকে ছেলেদের ডোবা থেকে মরদেহ উদ্ধার করছে। কিন্তু আমার ছেলেদের দেখতে পারছি না। একটু দূরে গিয়ে দেখি বড় ছেলে সাদ্দাম রাস্তার পাশে শুয়ে আসে। তার পুরো শরীর কর্দমাক্ত। কিন্তু ছোট ছেলেকে দেখছি না।’
‘এবার একজন আমাকে ডাক দিয়ে বলে শাখাওয়াতকে উদ্ধার করা হয়েছে। আমি ভাবছি আমার ছেলে জীবিত আছে। কোলে নিয়ে দেখি আমার ছোট মিয়া বেঁচে নেই। এখন বড় ছেলেকে দূরে কোথায়ও যেতে দিতে ভয় লাগে। আমার স্ত্রী হাজেরা বেগম এখনো মাঝরাতে ছেলের জন্য কাঁদে। আমি এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় এক ফলক এই জায়গাটাকে দেখে যাই।’
১৩ নম্বর মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাস্টার কবির আহম্মদ নিজামী জাগো নিউজকে বলেন, ভয়াবহ মিরসরাই ট্র্যাজেডির কথা মনে উঠলে এখনো শরীর শিউরে ওঠে।
তিনি বলেন, ‘আমার ইউনিয়ন থেকে মিরসরাই স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যায় শিক্ষার্থীরা। আমি তখন উপজেলায় ছিলাম। সেদিন দুপুরে আমার কাছে ফোন এলো খেলা দেখতে যাওয়া ট্রাক ডোবায় ডুবে গেছে। কিন্তু কোথায় দুর্ঘটনা ঘটেছে তা বুঝতে পারছিলাম না। আমি একটি সিএনজি নিয়ে দ্রুত আবুতোরাব ছুটলাম। যাওয়ার পথে সৈদালী এলাকায় গিয়ে দেখি রাস্তার পাশে ছেলেদের শুইয়ে রাখা হয়েছে। তাদের দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না তারা মারা গেছে। একেবারে তরতাজা দেহ। আহ! একসঙ্গে এতগুলো তাজা ও মেধাবী প্রাণ চলে যাওয়া আমাদের জন্য বড় ক্ষতি হয়েছে।’
এসআর/এএসএম