ফেসবুক পোস্টে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সম্প্রতি নড়াইলের লোহাগড়ায় হিন্দুদের বসতবাড়িতে যে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে, তার নেপথ্যে ‘রাজনীতির গন্ধ’ পাচ্ছেন দেশের বিশিষ্ট সচেতন নাগরিকেরা। এমনকি বিগত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর পেছনে ‘রাজনীতি আছে’ উল্লেখ করে এর জন্য বিচারহীনতা ও ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করছেন তারা।
রোববার (২৪ জুলাই) রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টার অডিটোরিয়ামে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ আয়োজিত ‘সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা : নাগরিক প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্টজনেরা এ ধরনের মতামত দেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির নির্বাহী প্রধান অ্যাডভোকেট সাইদা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমার প্রশ্ন, সত্যিই কি রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে, নাকি সরকার সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে। যদি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কথা বলা হয়, চাঁদ দেখা ছাড়া তাদের আর কোনো কাজই নেই। ধর্ম মন্ত্রণালয় যদি রাখতেই হয়, তাহলে তাদের ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন’ আমাদের দেখতে হবে। আমাদের দেখা উচিত, রাষ্ট্র বা সমাজ এমনই হয়ে গেলো যে, একজন নিরীহ হিন্দুর ঘরেও লুটপাট চালাতে হয়।
তিনি বলেন, একটা দেশে জনগণ ছাড়াই যখন সরকার দুবার ক্ষমতায় যায় তখন আর জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা থাকে না। তৃতীয়বার আবারও জনগণকে ছাড়াই তারা ক্ষমতায় যাবে কি না, সে দুশ্চিন্তায়ও থাকতে হয়। আসলে জনগণকে ক্ষমতা ও রাষ্ট্র থেকে দূরে রাখা হয়েছে। আলাদা করে রাখা হয়েছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সাম্প্রদায়িক সব হামলার সঙ্গে রাষ্ট্র জড়িত, এ কথা ভুললে চলবে না। হামলার সময় যে আওয়াজ তোলা হয়, একই আওয়াজ আমরা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও শুনেছি। রাষ্ট্র তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। আসলে আমরা কোন রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। সেখানে জনগণের অধিকার ও সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রে তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যতো উন্নয়ন হচ্ছে, ততো বৈষম্য বাড়ছে। সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে, নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। ধনিরা ধনি হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। রাষ্ট্রের সর্বত্র আজ এ বৈষম্য আমরা দেখছি।
তিনি বলেন, নড়াইলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় যে নয়জন গ্রেফতার হয়েছে তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি রয়েছে। তাহলে আমরা বলতেই পারি, এসব হামলার পেছনে রাজনীতি রয়েছে। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’- এ জায়গায় যেতে হলে আমাদের সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে হবে। আমরা তো চলে যাচ্ছি সেই আদিমতার জায়গায়। এ অবস্থা থেকে বের হতে আমাদের সংস্কৃতিচর্চা দরকার।
প্রখ্যাত অভিনেতা মামুনুর রশিদ বলেন, গত ৫০ বছরে আমি আমাদের কোনো রাষ্ট্রই দেখিনি। আমরা জানি, একজন শিক্ষকের শুধু পা স্পর্শ করা যায়। কিন্তু, আমাদের দেশে শিক্ষককে অপমান করা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে, গায়ে হাত তোলা হচ্ছে। রাষ্ট্রও সেখানে সামিল হচ্ছে। বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িকতা থাকার কথা না। যারা সাম্প্রদায়িকতা করছে, তারা আসলে লুটেরা।
‘নড়াইলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা-লুটপাটের ঘটনার ১৩ দিনের মধ্যে ওই এলাকার সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তোজার কোনো খোঁজ ছিলো না’- অভিযোগ করেন তিনি।
মামুনুর রশিদ বলেন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি একসঙ্গে যুক্ত। শিক্ষাকে সুস্থ করা না গেলে সংস্কৃতিকে কীভাবে সুস্থ করবো। অন্যথায় সাংস্কৃতিকভাবে এসব হামলা মোকাবিলা করাও সম্ভব না। শিক্ষার অবস্থা এমন যে, আমরা যে লিখি তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না। মানুষ এখন আর প্রিন্ট পত্রিকা পড়ছে না। আমাদের লেখা কার কাছে পৌঁছাচ্ছে, আমরা জানি না।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, এ মুহূর্তে যারা নড়াইলে বসবাস করছেন তাদের নিরাপত্তার জন্য আমরা কী করতে পেরেছি, এটাই এখন বড় প্রশ্ন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, যাদের সামনে নড়াইলের ঘটনা ঘটেছে তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছে কি না আসলে সেখানে কী ঘটেছিলো। আমরা অতীতে দেখেছি দেশের বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজনদের এসব ঘটনার তদন্ত ও উদঘাটনে পাঠানো হতো। কিন্তু এখন আর সেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কমিশন গঠনের জন্য আমাদের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উচিত সরকারকে চাপ দেওয়া।
‘ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়। ধর্মীয় বিদ্বেষের সংজ্ঞা তাহলে কে দেবে’- প্রশ্ন রাখেন তিনি।
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, বিগত কয়েক বছরে শিক্ষকদের যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, অপমান করা হয়েছে, যেভাবে তাদের ওপর হামলা ও হত্যা করা হয়েছে, এর পেছনের গল্প একই।
তিনি বলেন, বলা হয়, সাম্প্রদায়িক হামলায় আগুন দেয় জামায়াত-বিএনপির লোকেরা। কিন্তু এখন তাদের মেরুদণ্ড কতটুকু আছে তা আমি জানি না। হামলা যেই করুক না কেন, লুটপাট তো চলে দলমত নির্বিশেষে। হামলার আগে মিটিং করা হয়। একসঙ্গে বসে পরিকল্পনা করা হয়। লোক জড়ো করা হয়। তখন কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। তখন প্রশাসন কী দায়িত্ব পালন করে।
তিনি আরও বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, সাম্প্রদায়িক হামলার আড়ালে সব গল্প সাজানো। সাম্প্রদায়িক হামলা ও লুটপাটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজনই জড়িত। আমাদের সংখ্যালঘু ২২ জন সংসদ সদস্য আছেন। নিজেদের এলাকার জন্য তারা কিছুই করেন না। তাদের কাছে গেলে বলেন, ‘আমাদের হাত-পা বাঁধা’। তাহলে সংসদে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব রইলো কোথায়। যারা ক্ষমতাসীন তারাই সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রশ্নে চুপ করে থাকেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের মহাসচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন নিয়ে আমার প্রশ্ন হলো, এ পর্যন্ত কতজনের বিচার হয়েছে। আমি জানতে পেরেছি, রামুর ওই ঘটনায় আজও কোনো বিচার হয়নি। কুমিল্লার নানুয়ারদীঘির পাড়ে মন্দিরে হামলার ঘটনার বিচার হয়নি। যদি এরকম বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেশে থেকে যায়, তবে সাম্প্রদায়িক হামলা থেকে কোনোদিনই আমরা বের হতে পারবো না।
তিনি বলেন, সরকার থেকে বলা হয় তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি। সরকারের লোকেরা বলছে, তাদের বিভিন্ন দপ্তর ও সরকারি অফিসে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ঢুকে গেছে। কিন্তু একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমি যতটুকু জানি, সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে অনেক যাচাই করা হয়। এখন তো আরও বেশি কড়াকড়ি। এখন তো সব সেক্টরকে দলীয়করণ করা হয়েছে। তারপরও যদি এসব ঘটনা ঘটে তাহলে কীভাবে এই সরকারকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ড. সারওয়ার আলী বলেন, আমাদের যাদের মুক্তিযুদ্ধ করার সৌভাগ্য হয়েছে, আমরা যে রাষ্ট্রটি চেয়েছিলাম বর্তমান রাষ্ট্র সেখান থেকে পথভ্রষ্ট হয়েছে। সমাজের বহুজনের মনের মধ্যে ইসলাম ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যা স্থান পেয়েছে। অথচ কোনো ধর্মই অন্য ধর্মের অবমাননা সমর্থন করে না। লালন থেকে শুরু করে শাহ আব্দুল করিম, সবাই উদারতার কথা বলে গেছেন। তৃণমূল পর্যায়ে যারা রাজনীতি করেন তারা ধর্মের নামে লুণ্ঠনে লিপ্ত হন। তৃণমূলে রাজনীতিতে নানা ধরনের সমঝোতা হয়। রামু থেকে শুরু করে বিগত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ পর্যন্ত যেসব সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, সবগুলোই পরিকল্পিত।
আলোচনায় অন্য বক্তারা বলেন, আমাদের দেশ কতটা মানবিক তা নির্ভর করবে একজন সাঁওতাল কেমন আছে বা একজন সংখ্যালঘু কেমন আছে তার ওপর। আমাদের সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এখনো হয়ে ওঠেনি। এ নিয়ে কেউ কোনো কথাও বলে না। সংখ্যালঘু কমিশন গঠন জরুরি।
তারা বলেন, যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যাদের সামনে এসব হামলা হয় তারা চুপ করে দেখে যান। যারা অপরাধীদের ধরতে পারেন না তাদেরও শাস্তি হওয়ার দরকার। তাদের শাস্তির মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন হওয়া দরকার। রাজনীতিবিদরা নিজেদের এলাকার খবর রাখেন না। নিজেদের এলাকায় যখন কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয় তখন তারা নিজেদের লোক পাঠিয়ে খোঁজখবর নেন না। নড়াইলের লোহাগড়ায় যে গ্রামটিতে হামলা হয়েছে সেখানে হিন্দু পরিবারের সংখ্যা বেশি। ওই গ্রামে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু হামলার সময় সবাই চুপ করে ছিলেন। অথচ সবাই যদি তখন চিন্তা করতেন, আজকে ওমুকের বাড়িতে হামলা হয়েছে কাল আমার বাড়িতেও হতে পারে, তাহলে কিন্তু অপরাধীরা আর সাহস পেতো না। এজন্য আমাদের সচেতন তরুণদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অন্য বিশিষ্টজনেরাও তাদের বক্তব্য ও মতামত তুলে ধরেন।
এমআইএস/এমকেআর/জিকেএস