জাতীয়

চোখে অন্ধকার নিয়ে ঘরে আলো জ্বেলে যাচ্ছেন হিমা

শতভাগ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হিমা খাতুন। একসময় ঘর থেকে বের হতেন না। পেতেন না প্রতিবেশীদের কোনো সহযোগিতা। শুনতে হতো নানা কটু কথাও। পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েনে চরম কষ্টে কাটতো দিন। করোনাকালীন প্রতিবন্ধী ভাতা বন্ধ হলে অভাবের সংসারে নামে আরও ঘোর অন্ধকার। তখন কারও কাছে হাত পেতেও সামান্য টাকা ধার পাননি। তবে সময় বদলেছে। হিমার জীবনেও এসেছে আশার খানিক আলো।

একসময় শুধু ফোনকল রিসিভ করে কথা বলতে পারলেও এখন নিজেই যে কোনো নম্বর উঠিয়ে কল করতে পারেন। চিনেছেন টাকা, রাখতে পারেন হিসাব-নিকাশ। দু’চোখে অন্ধকার নিয়ে বেঁচে থাকা হিমা পেয়েছেন ডিজিটাল ছড়ি। তা দিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটাচলাও করতে পারেন নির্বিঘ্নে। স্বামীকে নিয়ে শুরু করেছেন বাদামের ব্যবসা। লিজে পাওয়া জমিতে চাষাবাদ ও ছাগল পালনেও এখন মনোযোগী এই উদ্যমী নারী।

রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলার পাটেশ্বরীর বাসিন্দা হিমা খাতুন। সম্প্রতি জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়ে নিজের মুখেই জীবন সংগ্রামের গল্প শোনান তিনি। কথা বলার শুরুতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেও দ্রুতই আবেগ সামলে নেন।

হিমা খাতুন জানান, পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অনেক সময় দু’বেলা খেতেও পেতেন না। নিজে অন্ধ হওয়ায় পরিবারের সহযোগিতায় কোনো কাজকর্ম করতে পারতেন না। এরই মধ্যে তাকে বিয়ে দেয় পরিবার। স্বামীর পরিবারও ছিল আর্থিকভাবে অবচ্ছল। থাকতেন হিমাদের বাড়িতেই। তবে টুকটাক বাদাম ভাজা ও বিক্রির যে কাজটুকু করতেন করোনার কারণে তা-ও থেমে যায়। এসময় হিমারও বন্ধ হয় প্রতিবন্ধী ভাতা। জীবনের এই কঠিন সময়ে স্বামীর বাদামের ব্যবসা চালু করতে প্রতিবেশীর কাছে এক হাজার টাকা ধার চেয়েও পাননি।

তবে গত বছরের শুরুর দিক থেকে হিমাদের জীবনে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। হিমা বলেন, ব্র্যাকের একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে বদলাতে শুরু করে জীবন। প্রথমে ব্র্যাকের আপা ও ভাইয়েরা আমাকে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেন। এখন আমি নিজেই যে কোনো নম্বর উঠিয়ে ফোনকল করতে পারি। হাঁটাচলা, হিসাব-নিকাশ করি। ওই প্রজেক্টের আওতায় আমাকে এক খণ্ড জমি লিজ নিয়ে দেওয়া হয় চাষাবাদের জন্য। ছাগল ও কিছু ক্যাশ টাকাও পেয়েছি। সেই টাকায় বাদাম কিনে ভেজে দিলে আমার স্বামী ঘুরে ঘুরে তা বিক্রি করেন। ঘরে ফিরে বিক্রির টাকার হিসাব বুঝিয়ে দেন। আমি হিসাব করে বাদামের প্যাকেট করে দেই। ৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন দামের প্যাকেট তৈরি করি। ব্যবসার টাকার ঠিকঠাক হিসাব রাখি। আবার মৌসুমে কিছুটা কমে পেতে পাইকারি দামে একসঙ্গে বাদাম কিনে মজুত রাখি। লিজে পাওয়া জমিতে ধান চাষ করছি। সেখান থেকে পরিবারের ভাতের জোগান আসছে।

হিমা বলেন, আগে মানুষ আমাকে নানা কটু কথা বলতো। এখন প্রতিবেশীরা আমার খোঁজখবর রাখে। সবাই আমাকে দাওয়াত দেয়। গ্রামে নারীদের একটি সমিতি আছে। সেই সমিতির টাকাও আমার কাছেই জমা রাখা হয়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে জীবন সংগ্রামী এ নারী বলেন, আমার ইচ্ছা আরও জায়গা নিয়ে চাষাবাদ করার। সন্তানকে কারিগরি বিষয়ে পড়াশোনা করানোর স্বপ্ন দেখি, ইনশাল্লাহ। আমি আমার ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। আরেকটা স্বপ্ন- বাবার বাড়িতে আর থাকতে চাই না। স্বামী-সন্তান নিয়ে আলাদা একটা বাড়ি করবো। পাকা বাড়ি।

চোখে আলো না থাকলেও সংসারে আলো জ্বেলে যাওয়া হিমা বলেন, ব্র্যাক আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত তারা খোঁজ নিতো। যখন প্রতিবেশীরা আমাকে সামান্য সহযোগিতাটুকুও করেনি, তখন বাদামের ব্যবসা, ছাগল কিনে দেওয়া, মোবাইল কেনা, টাকা গোনা, হাঁটাচলার জন্য ডিজিটাল ছড়ি কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় আমার জন্য। ঘরের কোণে পড়ে থাকতাম, ভাতের কষ্টও ছিল। এখন আমার ভাত-কাপড়ের কোনো কষ্ট নেই।

শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ও অসচ্ছল মানুষদের জন্য ‘আল্ট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম’র আওতায় হিমা খাতুনকে নিয়ে কাজ শুরু করে ব্র্যাক। বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রজেক্ট ক্যাটাগরিতে এসব সহযোগিতা দেওয়া হয়।

হিমা খাতুনকে নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের স্থানীয় সাইকো সোশ্যাল অফিসার আইনুন নাহার আন্নি জাগো নিউজকে বলেন, শুরুর দিকে হিমা কথাই বলতেন না। শুধু কান্না করতেন। আমরা তাকে উৎসাহ দেই। সাহস জোগাই। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না আমরা তাকে সহযোগিতা করবো। প্রশিক্ষণ ও নানা সহযোগিতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে আমরা তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলি।

এএএম/এমকেআর/এমএস