মতামত

প্রসারে অভিনবত্ব প্রতিরোধে চাই নতুনত্ব

মানুষের সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ধরা পড়তেই হলো। রানা হাওলাদার নামের এই ব্যক্তির একটি হাত নেই। বিদ্যুৎস্পৃষ্টে শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর চিকিৎসক বাম হাতের কনুইয়ের নিচের অংশ কেটে ফেলেন। সেখানে সংযোজন করা হয় কৃত্রিম হাত। পঙ্গুত্বের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম হাতের ফাঁকা জায়গায় ইয়াবা বহন শুরু করেন রানা হাওলাদার (২৬)।

পেশায় একজন অটোরিকশাচালক। কিন্তু মাদককারবারিকে সে পেশা হেসেবে নিয়েছে। অটোরিকশা চালিয়েই সে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যাত্রী আনা নেওয়ার পাশাপাশি ইয়াবা সরবরাহ করতো। বাম হাতে প্লাস্টিকের কৃত্রিম হাত সংযুক্ত থাকায় তাকে তেমন কেউ সন্দেহের চোখে দেখেনি, আবার সে সবার সহানুভূতিও পেতো।

এই সহানুভূতি সে কাজে লাগাতো কারবারে। চার বছর ধরে এমন অভিনব কায়দায় ইয়াবার কারবার চালিয়ে আসছিল এই ব্যক্তি। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। সূত্র: (জাগো নিউজ)

অভিনব কায়দায় মাদক কারবারি চালিয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। নিষিদ্ধ বস্তু হওয়ায় মাদক পাচারকারিরা অভিনব সব পন্থা অবলম্বন করে পুলিশের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য। কারাগারের ভেতরেও ঢুকছে মাদক। টিফিন ক্যারিয়ারের ভেতর বিশেষ কায়দায় জুতার সোল ও শুকনো খাবারের ভেতর গোপনে মাদকপাচার।

এছাড়া পরিধেয় শার্টের কলার ও হাতায়, প্যান্টের কোমরের অংশে এবং টিফিন বক্সের ভেতরে করে মোবাইল, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ নিষিদ্ধ পণ্য কারা অভ্যন্তরে নেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের অপতৎপরতা বন্ধে কারা কর্তৃপক্ষকে নজরদারি বাড়াতে হবে। কারাগার হচ্ছে সংশোধনাগার। সেখানে যদি মাদক ঢোকে, তাহলে অবস্থা কী হবে ভাবা যায়!

অ্যাম্বুলেন্স বা কফিনে করে মাদক বহন করলে অনেক সুবিধা। এতে অনেকের চোখ ফাঁকি দেওয়া যায়। যানজটে পড়লে সাইরেন বাজিয়ে উল্টো পথেও চলে যাওয়া যায়। র‌্যাব-পুলিশের চেকপোস্টে তল্লাশিতেও পড়তে হয় না। কারণ কফিনবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্সকে সাধারণত কেউ সন্দেহের চোখে দেখে না।

এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় যে মাদককারবারিরা মাদকপাচারের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের মতো একটি জরুরি ও স্পর্শকাতর পরিবহন ব্যবহার করছে। এতে কোনো অ্যাম্বুলেন্সে সত্যিকারের রোগী বা কফিনের ভেতরে আসলে লাশ না অন্য কিছু আছে, এ নিয়ে সন্দেহ দেখা দেওয়াটা স্বাভাবিক। এ নিয়ে অর্থাৎ পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারকারী উভয় পক্ষকেই বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। আর এ সুযোগই নেয় মাদক কারবারিরা।

শুধু স্থলপথেই নয়, আকাশপথেও পাচার হচ্ছে মাদক। রাঘববোয়ালরা এর সঙ্গে জড়িত। এমনকি বিমান বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যদি মাদকের মতো নিষিদ্ধ জিনিস পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকে, সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। কাজটি বেআইনি তো বটেই, দেশের সম্মানের সঙ্গেও এটি জড়িত। তাই এ ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কোনো বিকল্প নেই।

রানা হাওলাদার যা করেছে সেটি তার মতো কৃত্রিম হাত-পা লাগানো মানুষের প্রতি সন্দেহের উদ্রেক করবে। অনেকেই এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে পারেন। তাছাড়া নিজের অসহায় অবস্থাকে পুঁজি করে মাদক কারবারিতে জড়ানো অত্যন্ত গর্হিত কাজ। মাদক কারবারি বন্ধে এদের দমন করতে হবে।

নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। বিশেষ করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজলভ্য ও বহনযোগ্য বলে এর বিস্তার দেশজুড়ে। সত্যি বলতে কি, দেশের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে মাদকের থাবা নেই। দেশজুড়ে এক বিশাল জাল বিস্তার করে আছে এ মরণনেশার ভয়াবহ সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক অপরাধীচক্র মাফিয়াদের সঙ্গে রয়েছে এদের শক্ত ও গভীর যোগাযোগ।

মাদক চোরাচালানের জন্য রয়েছে বিভিন্ন রুট। বিমানবন্দর থকে শুরু করে স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সীমান্ত এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ি। এর কিছু ধরাও পড়ে। বাকিটা চলে যায় মাদকসেবী ও কারবারিদের কাছে। এছাড়া কারাগারেও রয়েছে মাদকের জমজমাট ব্যবসা।

রাজধানীর উপকণ্ঠে স্থানান্তরিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে অভিনব কায়দায় মাদক ও বিভিন্ন নিষিদ্ধ পণ্য পাচারের অভিযোগ উঠেছে। কারাগার কর্তৃপক্ষ এ ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও অনেক সময় চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদক ঢোকে কারাগারে। মোবাইল ফোন দিয়ে কারাগারে বসে শীর্ষ পর্যায়ের অপরাধীদের মাদক কারবার, চাঁদাবাজিসহ অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণের খবরও অজানা নয়।

এটা খুবই আশঙ্কার বিষয় যে বাংলাদেশে দিন দিন মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে। শুধু তা-ই নয়, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মাদক কারবারের ট্রানজিট রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশ; যার সর্বশেষ নজির দেখা গেলো ফেনীতে। এজন্য একজন আনসার সদস্যকেও জীবন দিতে হলো। এ অবস্থায় মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করতে হবে। মাদকদ্রব্য কোনো অবস্থায়ই যাতে দেশের ত্রিসীমানায় ঢুকতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে যেকোনো মূল্যে।

শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। তার বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও অমিত সম্ভাবনা। এই মরণনেশার বিস্তারে সমাজে একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে, তেমনিভাবে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে মাদক কারবারে। কেউ কেউ ধরাও পড়ছে। কিন্তু মাদককারবারি থামছে না। এটি বাড়তি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলেন, মাদক সব অপরাধের মূলে। মাদকের সঙ্গে জড়িতরা নানামুখী অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। খুনখারাবি, পতিতাবৃত্তি, চোরাচালান, পাচারের মতো বড় অপরাধের একটি নেটওয়ার্ক বা জাল তৈরি হয়। ফলে মাদক নির্মূল করা গেলে অনেক অপরাধের যবনিকাপাত করা সম্ভব অঙ্কুরেই।

মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে হলে মাদকদ্রব্যের প্রাপ্তি সহজলভ্য যাতে না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যেকোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে মাদকের অনুপ্রবেশ। দেশেও যাতে মাদকদ্রব্য উৎপাদন হতে না পারে, সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে হবে। ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানে মাদক দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান চালায়। এতে অনেক ধরাও পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখনো মাদককারবারিদের অপতৎপরতা থেমে নেই।

দুঃখজনক হচ্ছে, মাঝে মধ্যে মাদকের চালান ধরা পড়লেও তাদের মূল কুশীলবরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, সমাজের প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। তাছাড়া মাদককাররিরা যে ধরনের অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তাদের প্রতিরোধে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে।

মাদকের ভয়াল থাবা থেকে দেশ বাঁচাতে হলে মাদক সিন্ডিকেট যতই শক্তিশালী হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতারও কোনো বিকল্প নেই। যারা এরই মধ্যে মাদকাসক্ত হয়েছে, তাদেরও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বাড়াতে হবে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যাও। সর্বোপরি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে যার যার অবস্থান থেকে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে এই যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে। মাদক নয় জীবনমুখী হতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।drharun.press@gmail.com

এইচআর/ফারুক/এএসএম