সাহিত্য

ভোঁ-কাট্টা

- এই- ইইইশশহহ- ধ্যাত!! সদ্য ভোঁ-কাট্টা খাওয়া ঘুড়ি থেকে ‘অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’ সূত্রে পিচ্চিদের কারো আওয়াজ তুলবার আগেই তাদের দিকে তীব্র বিরক্তি নিয়ে চোখ ফেরালো নিটোল।- কে মাঞ্জা দিয়েছে ঘুড়িটায়? - ভাইয়া মাঞ্জা ঠিক ছিল। আপনার আঙ্গুল কেটে রক্ত বের হচ্ছে মাঞ্জার ধারে! সবসময় যেকোনো সাইজের দলেই বিভিন্ন নমুনা থাকে। এই দলের “বেত্তমিজ” নমুনা হচ্ছে সজল। হাফপ্যান্ট পরে কি পরে না, পাকনামিতে ওভারকোট!নিটোল থাপ্পড় মারবে নাকি ঝাড়ি মারবে সিদ্ধান্ত নিবে নিবে অবস্থা, এর মধ্যে ভাইভা বোর্ডের প্রশ্নকর্তা নিপু,- একদিনও আমরা ঐ বিল্ডিংএর সাথে পারিনা কেন? কে খেলে ঐ বিল্ডিংএ ? আগে তো এমন হয় নাই! তারচেয়ে বড় কথা ঘুড়িগুলি ফেরৎ পাইনা কেন? আম্মু বলছে আর ঘুড়ি কেনার টাকা দিবেনা। -  এ-হ-আসছে! কয়টা ঘুড়ি কিনছে আম্মু ? ঘুড়ি ফেরৎ পাইনা কেন! চাইতে পারিস না পাশের বিল্ডিংএ গিয়ে? -  দরজা খুলে না। গেটে বিশাল কুকুরও আছে। -  ঐটা তো বান্ধা থাকে!-  না ভাইয়া, মাঝেমাঝেই ছাড়ে। আজকে আপনি যান, আপনিই তো খালি ঘুড়ি কাট্টা খাওয়ান। লম্বা লম্বা পা চালিয়ে পাশের বিল্ডিংএ রওনা দিল নিটোল।আজকে এই বেত্তমিজগুলির একদিন কি তার একদিন।এমনিতেই এইবয়সে পিচ্চিদের সাথে ঘুড়ি খেলে বেড়ায় বলে সবাই উদ্ভট দৃষ্টিতে দেখে। পিচ্চিগুলি তাও বিশিষ্ট ‘দুধেল গাই’ বড়ভাই হিসেবে মেনে চলে, আবোল তাবোল খুচরা আব্দার মেটানোর বিনিময়ে। কিন্তু নিয়মিত এমন ঘুড়ি গায়েব না থামাতে পারলে অন্যদের উদ্ভট দৃষ্টির আছর এদের উপরেও পড়বে। আজ বেত্তমিজি করছে, কাল খেলতেই দেবেনা! পাশের বাড়িটাকে বিল্ডিং বলা অনেক বেশি সমীহ করা। ভূতের বাড়ি বিশেষ! শ্যাওলা, দেয়ালের ফাটলে গাছ- কি নাই? লোহার গেটে ধ্রিম ধ্রিম কষাঘাত দিল। যেই রুদ্রমূর্তি নিয়ে সে এসেছে তার ফর্ম পরতে দেয়া যাবে না- ঘুড়ি ফস্কে যাবে!ভেতরে সরাইলের কুকুর বিকট সরে ডাকছে। দারোয়ান কুকুরটাকে সামলে দোরটা খুলেই তার হাতে এত্তগুলি ঘুড়ি ধরিয়ে ধাতব কণ্ঠে “ ঘুড়িগুলান পইড়েন’’ বলে দোর লাগিয়ে দিল।নিটোল হতভম্ব! কি পড়বে? ঘুড়ি কি বই নাকি? চুলোয় যাক। এতোদিনের সব ঘুড়ি! মেঘ না চাইতে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত! শিনা ৫০ ইঞ্চি ফুলিয়ে জেমস বন্ড লুক নিয়ে ধরলো পিচ্চিদের সামনে।- চিঠিগুলি পড়ছেন ?  - কিসের চিঠি ?- এইযে-সব ঘুড়ির লেজে লেখা! প্রাইভেট-! সজল পাকনামিতে অস্কার পাবে! টিপিকাল ফাজিল হাসি অনেক কষ্টে ঠোঁট চেপে মুখ ডান-বাম করে আটকে রেখেছে। নিটোল দ্রুত সজলের ঘুড়িটা নিয়ে লেজে চোখ বুলালো। “ আজকেও সুতা না পেঁচিয়েই হ্যাঁচকা টান? ঘুড়ি কবে শিখবেন ? পারেন না, তাও রোজ বাচ্চাগুলির সামনে প্রেস্টিজ পাংচার ? একদিন শিখে যাবেন। আমিই শিখিয়ে যেতাম, কিন্তু..” এ কেমন ধারার চিঠি? ত্রস্ত হাতে সবগুলি ঘুড়ি নিয়ে দ্রুত ঘরে এলো। মাবুদ জানেন, আর কি কি লেখা আর পাকনাগুলির এক্স-রে চোখ কতদূর স্ক্যান করে ফেলছে! ছোট ছোট সব চিঠি। “ -শার্ট ময়লা ছিল কেন? নীল পাঞ্জাবীর বোতাম ছিঁড়েছে, লাগানো হয়নি কেন?- “ খুঁটিনাটি। তেমন কিছুই না, আবার খুব বিশেষ কিছু। শার্লক হোমসের দুর্বোধ্য সাংকেতিক চিহ্নে গুপ্ত রহস্য! ঘুড়ি হাতেই ফের গেল সেই বাসায়।মৃদু আঘাতেই দারোয়ান দরজা খুলে তেতলায় নিয়ে গেল। ছাদের ওপর অর্ধেক ফ্ল্যাট। ছাদের রেলিং অনেক উঁচু বলে কে যে খেলে এই বিল্ডিং এর  তা কোনোদিন দেখতে পায়নি । ফ্ল্যাটের কেউ যেন জানতোই নিটোল এখন আসবে।টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ম্লান চেহারায় মেয়েটি বসে; অপেক্ষায়।- বসুন। অনেক দেরি করলেন আসতে।- কিসের দেরি?- না মানে, সেই কবে থেকে ঘুড়ি জমছে, কিন্ত- আপনার বোধহয় চাকরির পয়সা তেমন লাগেনা, না? ঘুড়ি রোজ হারালে কিছুই এসে যায় না! কিন্তু হারার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ, মানুষের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। শখে বাচ্চাদের নিয়ে খেলেন, ঘুড়ি হারান, সবাই মজা নেয়- এটা ঠিক না। তাই শিখে যেতে লিখেছিলাম। - এ বাড়িতে আপনিই খেলেন ঘুড়ি? একাই ? - হুম তো ! বিশ্বাস হচ্ছে না?মেয়েটির ম্লান মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অঝর বৃষ্টির পর রংধনুর মতো সাতরঙা কেমন উষ্ণ দুষ্ট-মিষ্টি হাসি খেলে গেল!- না না , বলছিলাম রোজ এমন ঘুড়ি কাটানো- একাই! এতো কে শেখালো ?  এবার মেয়েটির ‘কিশোরী’র কাঁচভাঙ্গা হাসিতে মন খারাপ করা ঘরটাও উজ্জ্বল হয়ে গেল। এভাবে আধো-অন্ধকার ঘরে বসে একা মেয়েটির সাথে আলাপচারিতা নিটোলের সমীচীন মনে হোল না। দ্রুত প্রসঙ্গে ফিরে এলো, - বাচ্চাগুলি তো নাকি অনেকবার এসেছিল ঘুড়ি নিতে, দরজা খোলেনি।  - ঐ যে - আপনাকে শেখাবো বলে আপনার আসার অপেক্ষা করছিলাম! নিটোলের ভ্রু’র মাঝখানে ভাঁজ পড়লো। এসব হেয়ালীপনা, অস্পষ্ট কথা তার ভালো লাগে না বলেই সে বরাবর মেয়েদের এড়িয়ে চলে। গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, - তো নিজেই গেলেন না কেন ? - যাচ্ছিলাম তো! মার্চের ৫, আপনার জন্মদিনে! রাতের বৃষ্টির পানি সিঁড়িতে জমেছিল। তাড়াহুড়োয় পা পিছলে পরে গেলাম। আর না-উঠতেই পারলাম না! মেয়েটির চেহারায় ঠিক আগ মুহূর্তের উচ্ছলতার কয়েকগুণ বিষণ্ণতা নেমে এলো ঝুপ করে। যেন হঠাৎ গ্রহণগ্রস্থ হয়ে মিলিয়ে গেল গোটা চাঁদটাই । - উঠতে পারলাম না মানে?মেয়েটি স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ তাঁর লম্বা ম্যাক্সির ঝুলে আবৃত পায়ের দিকে। অনেক কষ্টে ডান হাত পেছনে মুড়িয়ে সোফার পেছনে রাখা হুইল-চেয়ারটা টেনে সামনে আনার চেষ্টা করলো। দাঁত চেপে আটকে রাখা অক্ষমতার নোনা জল গাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে। নিটোল দৌড়ে গিয়ে চেয়ারটা জায়গাতেই আটকে দিল।- ছাড়ুন। লাগবে না।মেয়েটি গভীর বিস্ময়ে বিরবির করে উচ্চারণ করলো, -  আমিতো হুইল চেয়ার ছাড়া হাঁটতেই -- পারবেন। আমার পায়ে।মাস ছয়েক গড়িয়ে গেল। নিটোলরা নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে। সুন্দর ছিমছাম আয়োজনে নতুন বউ হয়ে এসেছে তিতির, ছোট্ট তিতির পাখির মতোই ঘুলঘুলি গলে ঢুকে সবটা জুড়ে রাজত্ত্ব সাজিয়ে বসেছে। লিফট থেকে নেমে গাড়ির দিকে এগুতেই পড়শী শাফকাত ভাইয়ের দেখা। তিতির বরাবরের মতোই নিটোলের কোলে। কিছুটা আরক্তিম, খানিকটা বিব্রত। তবুও মাস ছয়েকে নিটোলের এই গোয়ার্তুমিতে সে অভ্যস্ত প্রায়। - বাপরে নিটোল! তোমার বাসর রাত দেখি ফুরায় না! আমি তো বিয়েরদিন দরজা থেকে বাসরঘর অব্দি নিতেই কাঁত! - জী ভাই, আমার বাসর ফুরায় না। নিটোল তিতিরের দিকে ফিরে গাঢ় কণ্ঠে বলল,‘‘আমার বউটা এতো দামী, তাঁর এমন সুন্দর কোমল পা মাটিতে রাখলে ময়লা হয়ে যাবে!” - মাশাল্লাহ! প্রার্থনা থাকবে, বাসরটা যেন কোনোদিনই ফুরায় না!- ফুরাবে না, দেখবেন! যেদিন ফুরাবে সেদিন আমি দুনিয়া থেকেই ভোঁ-কাট্টা!এইচআর/আরআইপি