মতামত

রাজনীতি কোনো তামাশা নয়

মানুষ রাজনীতি করে মানুষের জন্য। একেক দলের আলাদা আলাদা আদর্শ, আলাদা লক্ষ্য, আলাদা উদ্দেশ্য। কাছাকাছি আদর্শের দল কখনো কখনো জোট বাঁধে, আবার সে জোট ভেঙেও যায়। তবে সব রাজনৈতিক দলেরই মূল লক্ষ্য জনগণের সেবা করা, নিজ নিজ আদর্শের পক্ষে জনগণের সমর্থন আদায় করা। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরই মূল লক্ষ্যের ব্যাপারে কোনো খেয়াল নেই, জনগণের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

Advertisement

বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক দল আছে কয়েকশো। এর মধ্যে ৩৯টি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। কিন্তু নিবন্ধিত দলগুলোর কয়টির সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক আছে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং নিবন্ধন না থাকা জামায়াতে ইসলামীর নির্দিষ্ট ভোট আছে। এর বাইরে আরও গোটা দশেক দলের অল্প-স্বল্প হলেও ভোট আছে। কিছু পরিচিত বাম দল আছে, জনগণ যাদের ভালো জানে, কিন্তু ভোট দেয় না। কয়েকটি ইসলামী দলের জলসায় মানুষ আসলেও ভোটের বাক্স থাকে মরুভূমি। নিবন্ধিত বাকি দলগুলোর সঙ্গে জনগণের কোনো যোগাযোগ নেই। সাধারণ জনগণ এদের নামও জানে না।

জনগণ নাম না জানলেও তাদের রাজনীতি করার খায়েশ আছে ষোলোআনা। তারা নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনও চান। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধনের আবেদন চেয়েছিল। এবার ৯১টি দল নিবন্ধন পাওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে, যাদের বেশিরভাগই নামসর্বস্ব।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও ৭৬টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। তবে সেবার নির্বাচন কমিশন কোনো দলকেই নিবন্ধনের যোগ্য মনে করেনি। পরে অবশ্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে দুটি দল নিবন্ধন পেয়েছিল। এবার যে ৯১টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে, আমার বিবেচনায় তাদের একটিও নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য নয়। নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই তাদের আবেদন যাচাই-বাছাই করেই সিদ্ধান্ত নেবে।

Advertisement

নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত যোগ্যতা যাচাই করলেই তাদের অধিকাংশের আবেদনের অসারতা প্রমাণ হবে। নতুন দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে হলে একটি দলের নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটি, সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কার্যালয়, অন্তত একশো উপজেলা বা ক্ষেত্রমতে মেট্রোপলিটন থানার প্রতিটিতে কার্যকর কার্যালয়সহ অন্তত দুইশো ভোটার সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকতে হবে।

নিবন্ধন পাওয়া ৩৯টি দলের কয়টি সত্যি সত্যি এই শর্তগুলো পূরণ করেছে, সেটা নিয়েই আমার সন্দেহ আছে। নতুন আবেদন করা ৯১টির ব্যাপারে সন্দেহ আরও প্রবল। নতুন দলগুলোর মধ্যে অল্প কয়েকটি ঢাকায় নানা কর্মসূচি পালন করলেও সারাদেশের কয়টি জেলা বা উপজেলায় তাদের অফিস আছে, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।

বেশিরভাগেরই কোনো শর্ত পূরণের ন্যূনতম যোগ্যতাও নেই। আবেদন করা দলগুলোর মধ্যে জামায়াতের বিদ্রোহী এবি পার্টি যেমন আছে, জামায়াতের গোপন সংগঠন বিডিপিও আছে। বিএনপির একটি বি টিম বানানোর চেষ্টাও নাকি আছে। তবে বেশিরভাগই নামসর্বস্ব। সাইনবোর্ড সর্বস্বও বলা যাচ্ছে না, কারণ অনেক দলের সাইনবোর্ডও নেই।

আবেদন করা সবগুলো দলের নামের তালিকা তুলে দিলে এই লেখার আকার ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাবে। তবে আমি নিশ্চিত আবেদনকারী ৯১টি দলের বেশিরভাগের নামই কেউ শোনেননি। কয়েকটি নাম তবু শুনুন- মুসকিল লীগ, নাকফুল বাংলাদেশ, জনস্বার্থে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস), বৈরাবৈরী পার্টি, বাংলাদেশ তৃণমূল লীগ, নৈতিক সমাজ, নতুন বাংলা, বাংলাদেশ ইত্যাদি পার্টি, বাংলাদেশ বিদেশ প্রত্যাগত প্রবাসী ও ননপ্রবাসী কল্যাণ দল, বাংলাদেশ জনমত পার্টি, বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ আম জনতা পার্টি, বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি মুভমেন্ট (বিডিএম), বাংলাদেশ তৃণমূল জনতা পার্টি, বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল গ্রিন পার্টি, বাংলাদেশ সর্বজনীন দল, গণ রাজনৈতিক জোট (গর্জো), লাদেশ হিন্দু লীগ, তৃণমূল কংগ্রেস, বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট পার্টি (বিএইচপি), বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএনজিপি), জাতীয় স্বাধীনতা পার্টি, যুব স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বাংলাদেশ মাইনরিটি পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গ লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ সনাতন পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ জনতা পার্টি (বিজেপি), জনতার অধিকার পার্টি (পিআরপি), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগ, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় ইনসাফ পার্টি, সাধারণ জনতা পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ মানবতাবাদী দল, বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামিক পার্টি (বিইউআইপি), বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট গ্রিন পার্টি, গণ অধিকার পার্টি (পিআরপি), বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজেপি), যুবসমাজ পার্টি।

Advertisement

এই দলগুলোর কারও নাম কি আপনারা কেউ কখনো শুনেছেন? ধরুন, নির্বাচন কমিশন তাতের কাউকে নিবন্ধন দিল, আপনি তাদের কাউকে ভোট দেবেন? ভোট যদি না পায়, তবে তারা দল করে কেন, নিবন্ধন চায় কেন?

বাংলাদেশে যখন নিবন্ধন ব্যবস্থা ছিল না, তখন অনেক ব্যক্তি ও দল নির্বাচনে অংশ নিতো। কৃষক মোহাম্মদ সাদেক একজন ছিলেন যিনি ইউনিয়ন পরিষদ খেকে রাষ্ট্রপতি- সব নির্বাচনেই অংশ নিতেন। ছক্কা ছয়ফুর নামে একজন একবার সিলেটের একটি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনে এই হাস্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঠেকাতেই নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করা হয়। কিন্তু তাও পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি। কারণ দলগুলো নানা কৌশলে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিবন্ধন বাগিয়ে নেয়। এবার আবেদন করা দলগুলোর অনেকে নিজের বাসাকে অফিস হিসেবে দেখিয়েছেন, অনেকে আরেকজনের অফিসকে ঠিকানা করেছে।

নিবন্ধনের আবেদনকারী দলগুলোর তালিকা দেখে মনে হয়েছে, অনেকে স্রেফ তামাশা করার জন্য আবেদন করেছেন। আবার অনেকের তামাশার পেছনে আছে রাজনৈতিক স্বার্থ। যে কোনো নির্বাচনের আগেই রাজনীতিতে নানান মেরুকরণ হয়। কারা অংশ নেবে না নেবে তা নিয়ে চলে নানা দরকষাকষি। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়ও এটা হয়েছে। এই দরকষাকষির টেবিলে অনেকের লটারি লেগে যায়।

২০১৪ সালে বিএনএফ নামে এক নাম না জানা পার্টির প্রধান আবুল কালাম আজাদ একবার গুলশানের মতো অভিজাত এলাকার এমপি বনে গিয়েছিলেন। নিবন্ধনপ্রত্যাশী দলগুলোর মনে আসলে জনগণ নেই, আছে নিজেদের স্বার্থ আর বড় দলগুলোর সাথে দরকষাকষি। নিবন্ধন থাকলে মার্কেটে রেট বাড়ে। এ কারণে নিবন্ধন পেতে অনেকে মরিয়া হয়ে যায়।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, যারা শর্ত পূরণ করবে, শুধু তাদেরই নিবন্ধন দেওয়া হবে। কোনো শর্ত অপূর্ণ থাকলে নিবন্ধন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যাচাই-বাছাই শেষে আগামী জুনে এ ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ রাজনীতিকে যারা তামাশায় পরিণত করেছে, তাদের যেন নিবন্ধন দেওয়া না হয়। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম