দেশজুড়ে

প্রতিবন্ধীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন ভ্যানচালক সেলিম

মাদারীপুরে একটি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন ভ্যানচালক সেলিম শরীফ। সেখানে স্বেচ্ছায় শ্রম দিচ্ছেন ১১ জন শিক্ষক ও চারজন কর্মচারী। এ বিদ্যালয়টিতে উপজেলার ২২৫ জন প্রতিবন্ধী পড়াশুনার পাশাপাশি নানা ধরনের কাজ শিখচ্ছেন। আর শিক্ষার্থীদের তৈরি নানা ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি করে লাভের টাকা বিদ্যালয়ের কাজে ব্যয় করা হয়।

এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, রাজৈর উপজেলার শাখারপাড় এলাকার ভ্যানচালক সেলিম শরীফের মেয়ে মরিয়ম। তার মেয়ে প্রতিবন্ধী। আর তাই সমাজে অনেক ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছে সেলিমকে। তার মেয়ের কষ্ট দেখে সেলিম প্রতিবন্ধীদের সমাজের যোগ্য করে তোলার স্বপ্ন দেখে। এরপরই তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন। যেখানে প্রতিবন্ধীরা শুধু পড়াশোনাই না, কারিগরি শিক্ষাও পাবেন।

এমন চিন্তা থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। ২০২০ সালে বিদ্যালয়ের নামে রাজৈর উপজেলার শাখারপাড়ে ২০ শতাংশ জায়গা কিনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টিকে উন্নতি করতে ভ্যানচালক সেলিম শরীফ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। এরই মধ্যে রাজৈর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিদ্যালয়ে একটি টিনসেট ঘর তৈরি করে দেন। এরপর ২০২১ সালে বিদ্যালয়ের ২২৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বই বিতরণ, ৭০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে শীতবস্ত্র ও তিনটি হুইল চেয়ার বিতরণ করা হয়। এরপর থেকেই বিদ্যালয়টির নাম ছড়িয়ে পড়ে।

বিদ্যালয়ে ১১জন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাঠ্য পুস্তক পড়ানোর পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা দান করছেন। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষা সহায়করা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া শেখানোর পাশাপাশি নকশীকাঁথা তৈরি, ঠোঙ্গা তৈরি, মোমবাতি তৈরি, এলইডি বাল্ব তৈরি করা ও সেলাই প্রশিক্ষণের কাজ শেখাচ্ছেন। এখানে প্রতিবন্ধী শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের প্রতিবন্ধী আছেন। কেউ বাক প্রতিবন্ধী, কেউ শারীরিক প্রতিবন্ধী, আবার কেউ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।

এছাড়াও অন্যান্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও এই প্রতিষ্ঠান থেকে সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রতিবন্ধীরা যেন সমাজের বোঝা না হয়, তার জন্যই সেলিমের এমন মহৎ উদ্যোগ।

সেলিমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়ান রাজৈর পৌরসভার সাবেক মেয়র শামীম নেওয়াজ মুন্সি ও তার সহধর্মিণী মুক্তা নেওয়াজ। এছাড়া সমাজের অনেকেই এই প্রতিষ্ঠানে নানা সহযোগিতা করে আসছেন।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, এই বিদ্যালয়ের ১৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী বিনা বেতনে কাজ করছেন। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মুখে দিকে তাকিয়ে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের তৈরি এলইডি বাল্ব, মোমবাতি ও নকশীকাঁথা বিক্রি করা টাকার লাভের অংশ দিয়ে বিদ্যালয়ের খরচ চালান সেলিম শরীফ।

বিদ্যালয়টিতে সাতকক্ষ বিশিষ্ট দুইটি টিনসেট ঘর আছে। কক্ষগুলো শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া, কারিগরি শিক্ষা দেওয়া ও শিক্ষক মিলনায়তন হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রশাসন ও সুশীল সমাজের নেতারা প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়ানোতে খুশি ভ্যানচালক সেলিম শরীফ। বিদ্যালয়টিতে জাতীয় দিবসসহ নানা অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। বিদ্যালয়টিতে যাতায়াতের জন্য সুব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের।

প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা ও বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভানচালক মো. সেলিম শরীফ বলেন, বিদ্যালয়টি স্বীকৃতির জন্য সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। বিদ্যালয়টিতে ১০ জন অটিজম শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক ও একজন শিক্ষা সহায়ক প্রয়োজন। এমনি করে ২২৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ২০ জন শিক্ষক ও ২০ জন সহায়ক প্রয়োজন। কিন্তু শিক্ষকদের বেতন ভাতাদি দিতে না পারায় শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। বর্তমানে পাঁচজন শিক্ষক, পাঁচজন শিক্ষা সহায়ক, একজন প্রধান শিক্ষক ও চারজন কর্মচারী দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি সহায়তা না পেলে বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর আমি নিজেও ভ্যান চালিয়ে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আনা নেওয়া করে থাকি। ভ্যান চালানো অর্থ ও বিত্তবানদের দেওয়া অর্থ দিয়ে কোনো রকম বিদ্যালয়টি পরিচালনা করে আসছি। বিদ্যালয়টি সরকারি করণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা খাদিজা আক্তার বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বিদ্যালয়টি স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অনলাইনে আবেদন করা হয়েছে। বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১১জন শিক্ষক ও চারজন কর্মচারী বিনা বেতনে কাজ করছেন। শিক্ষার্থীরাও অবৈতনিকভাবে লেখাপড়া করছেন। বিদ্যালয়টির শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

রাজৈর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আনিসুজ্জামান বলেন, সরকারিভাবে বিদ্যালয়টির বাউন্ডারি করে দেওয়া হয়েছে। ওয়াশ ব্লক ও শ্রেণি কক্ষের জন্য ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই বিদ্যালয়টি সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হবে।

তিনি আরও বলেন, বিদ্যালয়টি মাদারীপুর জেলা প্রশাসন ও মাদারীপুর-২ আসনের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান খানের পক্ষ থেকেও সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। বিদ্যালয়টিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

জেএস/এএসএম