নীলফামারী হানাদার মুক্ত দিবস আজ (১৩ ডিসেম্বর)। ১৯৭১ সালের এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় নীলফামারী। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম মহকুমা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে একটি বাঁশের খুঁটিতে উত্তোলন করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা ও হাজার হাজার জনতারমুখে ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান।
জানা গেছে, সোহারাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর নীলফামারীর ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হতে থাকে। শুরুতে মিটিং-মিছিল আর সভা সমাবেশের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে দেশমাতৃকা রক্ষার আন্দোলন। মহকুমা শহরের অস্ত্রাগারে রক্ষিত অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে শহরের বড় মাঠে শুরু হয় অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ। এরপর ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। নয় মাসের গেরিলা আক্রমণ ও সম্মুখযুদ্ধে জেলার ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা ও কিশোরগঞ্জ উপজেলা মুক্ত করে তারা এগিয়ে আসেন নীলফামারী শহরের দিকে। ১২ ডিসেম্বর রাতে শহরের চারদিক থেকে প্রবল আক্রমণে হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়ে নীলফামারী শহর ছেড়ে শেষে আশ্রয় নেয় সৈয়দপুর সেনানিবাসে।
১৯৭১ সালে ৬ থানা নিয়ে নীলফামারী ছিল একটি মহকুমা শহর। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নীলফামারী জেলা ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন খাদেমুল বাশার। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এখানকার অগণিত ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম শুরু করেন। মহকুমা শহরে রক্ষিত অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ট্রেনিং শুরু হয়।
৫ এপ্রিল ইপিআর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যসহ হাজার হাজার জনতা ছুরি, বল্লম, বন্দুক, লাঠি নিয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের জন্য এগিয়ে যেতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য সৈয়দপুর থেকে নীলফামারী পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বাংকার করে ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা অপেক্ষা করেন।
৭ এপ্রিল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক, কামান ও ভারী অস্ত্র নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে নীলফামারী শহরের দিকে আসতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা আসার পথে শত শত বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানি সেনারা নীলফামারী শহরের দিকে আসতে থাকলে ইপিআর, পুলিশ, আনসারসহ সাধারণ ছাত্র-জনতা সীমান্তের দিকে সরে যান। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে সশস্ত্র ট্রেনিং নেওয়ার পর ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে গেরিলা আক্রমণ শুরু করেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের পরাস্ত করতে শুরু করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ১২ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নীলফামারী শহর ছেড়ে আশ্রয় নেয় সৈয়দপুর সেনানিবাসে। মুক্ত হয় নীলফামারী শহর। ১৩ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসে আনন্দ মিছিল করে এবং চৌরঙ্গী মোড়ে উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলার পতাকা।
৯ মাসের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন এম এ বাশার, আলী হাসান, আহমদুল হক প্রধান, আনজারুল হক ধীরাজ, জাহরুল ইসলাম, মোজাম্মেল হক, মিজানুর রহমান, মির্জা হাবিবুর রহমানসহ নাম না জানা অনেক বীর শহীদ হন নীলফামারীতে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে শহরের চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়ে জেলা শহর ছেড়ে আশ্রয় নেয় সৈয়দপুর সেনানিবাসে। আর ওই দিন রাত থেকেই মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী মানুষের বিজয় উল্লাসের ঢল নামে শহর জুড়ে। পরে ১৩ তারিখ সারাদিন চলে বিজয় মিছিল।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সার্বিক সহযোগিতায় নীলফামারী হানাদার মুক্তি দিবস পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড।
দিবসটি উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৩ডিসেম্বর) জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে জাতীয় ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদরে পতাকা উত্তোলন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এসব কর্মসূচিতে অংশ নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাধারণ মানুষসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
জেএস/এমএস