দেশজুড়ে

অরক্ষিত গল্লামারী বধ্যভূমি এখন মাদকের আখড়া

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বর্তমান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ছিল পূর্ব-পাকিস্তান রেডিও স্টেশন। সেখানে ক্যাম্প করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। এটি ‘গল্লামারী’ এলাকা হিসেবে পরিচিত। যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিকামী বাঙালি ও সাধারণ মানুষদের ধরে আনা হতো এ ক্যাম্পে। রাতের অন্ধকারে সেখানে চলতো নৃশংস হত্যাকাণ্ড। হত্যার পর মরদেহ পার্শ্ববর্তী ময়ূর নদসহ আশপাশের জলাভূমিতে ফেলতো পাকিস্তানি সেনারা। ফলে মরদেহের স্তুপে পরিণত হয় গল্লামারী এলাকা। যুদ্ধের পর গল্লামারী এলাকা থেকে পাঁচ ট্রাক মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছিল। পরে বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধ করার জন্য এ স্থানটি বেছে নেওয়া হয়।

দেশ স্বাধীনের পর খুলনাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত গল্লামারী বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১১ সালে এ স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করা হয়। তবে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী অবশিষ্ট থেকে যায় কাজ। একপাশে কিছু অংশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হলেও বড় অংশই রয়ে গেছে অরক্ষিত।

ফলে মুক্তিযুদ্ধে নাম না জানা অসংখ্য শহীদের রক্তে ভেজা গল্লামারী বধ্যভূমি এখন হয়ে উঠেছে মাদকসেবীদের আখড়া। সেখানে গরু-ছাগল চরানোও হচ্ছে। চলছে অসামাজিক কর্মকাণ্ড। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

জানা গেছে, বধ্যভূমির চারপাশের পুরো অংশে সীমানা প্রাচীরসহ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ শেষ করতে প্রয়োজন প্রায় ৯ কোটি টাকার। এ অর্থ বরাদ্দ হলে পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে গল্লামারী বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধ। তবে এক দশকেও সেই অর্থ বরাদ্দ মেলেনি। দিন যতই গড়াচ্ছে নির্মাণব্যয় বাড়ায় প্রয়োজনীয় টাকার অংকও বাড়ছে। ফলে বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধ নির্মাণ প্রকল্প অনিশ্চয়তায় মুখে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুলনা জেলা পরিষদের উদ্যোগে ২০০৮ সালে স্মৃতিসৌধটির নির্মাণকাজ শুর হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ছিল মূলস্তম্ভ, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, স্তম্ভের চারপাশে ১০ ফুট লাল টাইলস বসানো, পায়ে হাঁটাপথ, পার্কিং ইয়ার্ড, সীমানা প্রাচীর, ফটক, সিকিউরিটি শেড, রেস্টুরেন্ট, দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান, পানির ফোয়ারা রয়েছে।

তবে এসবের মধ্যে শুধু স্মৃতিসৌধ ও কিছু অংশের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ হয়েছে। যাতায়াতের পথে বসানো হয়েছে কিছু ইট। পথটি উঁচু না হওয়ায় অল্প বৃষ্টি হলেই পানিতে তলিয়ে যায়। এর বাইরে অধিকাংশ কাজই এখনো বাকি। কাজ শেষ করতে প্রায় ৯ কোটি টাকা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এ অর্থ আজও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ফলে থমকে আছে সব কাজ।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন খুলনার বীর মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ খুলনা মহানগর শাখার সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর কবীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার। এ সরকারের কাছে খুলনাবাসীর অনেক চাওয়া। সরকার তার সাধ্যমতো করছেও।’

তিনি বলেন, ‘খুলনার গল্লামারী বধ্যভূমি স্বাধীনতার ইতিহাস বহন করে চলেছে। এটাকে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। আমি সরকারের কাছে এ স্মৃতিসৌধের বাকি কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছি।’

তবে খুলনা জেলা প্রশাসন ও খুলনা জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দ্রুততার সাথে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানা গেছে।

খুলনা জেলা পরিষদের নব-নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদ বলেন, ‘সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী- গল্লামারী স্মৃতিসৌধের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে ৯ কোটি টাকার প্রয়োজন। বছর দুয়েক আগে এ হিসাব করা হয়। বর্তমানে নির্মাণসামগ্রীর দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে টাকার অংক আরও বাড়তে পারে।’

তিনি বলেন, ‘অর্থ বরাদ্দ চেয়ে একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠানো হলেও এখনো কোনো সাড়া মেলেনি। মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বরাদ্দ করা হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।’

খুলনার জেলা প্রশাসক ইয়াসির আরেফীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। দেশে চলমান উন্নয়নকাজের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের জন্য সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এসব স্থানগুলো সংরক্ষণ করা হবে।’

আলমগীর হান্নান/এএএইচ/এএসএম