প্রথমেই সবাইকে জানাই নতুন বছরের শুভ কামনা। ২০২৩ সালের প্রথম দিনটি থেকে শুরু করে শেষ দিনটি পর্যন্ত সকলের জন্য নিরাপদ হোক, কল্যাণকর হোক।
নতুন বছরের প্রত্যাশা বিষয়ে বলার আগে একটি বিষয় শেয়ার করি। ২০২২ সালের শেষ দিনটিতে আমি ঢাকার বাইরে কালিয়াকৈরে গিয়েছিলাম বিশেষ পারিবারিক কাজে। সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসি। দিনটি শনিবার। স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যাশা ছিল যানজট কিছুটা কম হবে। কিন্তু হায় ১ ঘন্টার পথ তিন ঘন্টায় যেতে হয়েছে। আসতেও সময় লেগেছে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা।
আমাদের যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে অবকাঠামোগতভাবে। বছরের শেষে মেট্রোরেল পেলাম। একসময় ঢাকা শহরের একটি বড় অংশ মেট্রোরেলের আওতায় আসবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ এগিয়ে চলছে। আরও বড় বড় সড়ক হবে। কালিয়াকৈর আসা যাওয়ার পথে দেখলাম ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়ক দারুণ সুন্দর।
আমরা পদ্মাসেতু পেয়েছি। ঢাকা মাওয়া এখন তুড়ি দিয়ে যাওয়া যায়। সবই ঠিক কথা। কিন্তু আমাদের মানসিকতার কি কোন উন্নয়ন হচ্ছে? মহাসড়কে যেখানে গাড়ি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলে সেখানেও দেখলাম হঠাৎ হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে। বাস স্টপেজ বলে কোনকিছুর যেন কোন অস্তিত্ব নেই। যেখানে সেখানে যখন তখন গাড়ি থামিয়ে একেবারে মাঝ সড়ক থেকে যাত্রী তুলছে বাসগুলো। একটু পথের ধারে সাইড করে রেখেও তারা কাজটা করছে না। রীতিমতো ডোন্ট কেয়ার। শুধু তাই নয়, একটি বাস অন্য বাসের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে, একটি অন্যটিকে লেজের বাড়ি দিচ্ছে একেবারে সড়কের মাঝখানেই। দেখছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম এটা কি কোন সভ্য দেশের পরিবহন ব্যবস্থার নমুনা হতে পারে?
শুধু বাস নয় অন্যান্য যানবাহনও কম অনিয়ম করছে না। রাস্তার রং সাইড দিয়ে আসছে গাড়ি। মোটর সাইকেলের তো কোন রং-রাইট আছে বলে মনেই হয় না। তারা ট্রাফিক সিগনালও মানে না। ঢাকার সব ফুটপাতের উপর দিয়ে মোটরবাইক চলে। তারা রীতিমতো জন্মস্বাধীন। তারা মানে নাকো কোনো আইন। ভীমভাসমান মাইনের মতোই তারা বিপদজনকও বটে।
প্রাইভেটকারগুলো পার্কিংয়ের সময় পুরো শহরকেই নিজের বাপদাদার তালুক বলে মনে করে। অর্ধেক রাস্তা জুড়ে পার্কিং করে রাখা গাড়ির দেখা মেলে অনেক জায়গাতেই। ঢাকায় এখন পথচারী পারাপার বলে জেব্রা ক্রসিংয়ের কোন অস্তিত্ব নেই। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর মতো জেব্রা ক্রসিং বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই তো সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে এক বেপরোয়া গতির প্রাইভেট কারের নিচে প্রাণ দিলেন এক নারী।
সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বাংলাদেশ রোজ কেয়ামতের আগে মুক্ত হতে পারবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থাকে নিরাপদ, সহজ, গণমুখী করার জন্য চাই আইনের যথাযথ প্রয়োগ। কিছু বলতে গেলেই পরিবহন সেকটরে কর্মরত ‘কতিপয় মাস্তান’ গোস্বা করে ধর্মঘট ডেকে দেশ অচল করে দিবে সেটা বন্ধ হওয়া দরকার। কিন্তু বন্ধ হবে কিভাবে? সর্ষের মধ্যেই তো মামদো ভূত। থাক এ বিষয়ে আর বেশি কিছু না বলি। শেষে ভূতে আমার ঘাড় মটকানোর পাঁয়তারা করবে।
২০২২ ছিল দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার বছর। এই পাগলা ঘোড়ার দৌড়ে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্তের মানুষের। আশা করি এবছর এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারবে সাধারণ মানুষ। আশাকরি অন্তত ভাত জুটবে সকলের। বিদায়ী বছরটা কেটেছে রিজার্ভ আতংকে। কখন দেশ ‘শ্রীলংকা’ হয়ে যায় সেই ভয়ে। পাশাপাশি দেখা গেছে সর্বস্তরে সীমাহীন দুর্নীতি। এ বছর আশাকরি সেই বিরাট লেভেলের দুর্নীতি দেখতে হবে না। বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে সেই অসম্ভব আশায় বুক বাঁধলাম।
বিদায়ী বছরে আরেকটি ন্যক্কারজনক বিষয় দেখা গেছে। পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নে উদ্ভট ও আপত্তিকর কিছু ঘটনা ঘটেছে। এটাও এ বছর দেখতে চাই না।
তবে বাংলাদেশ নারী ফুটবলদলের সাফ ট্রফি জয় আর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাফল্য মন জয় করেছে দেশবাসীর। শত বেদনার মধ্যেও আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে তরুণ ক্রীড়াবিদরা।
২০২৩ সালে কি প্রত্যাশা করে জাতি? অবশ্যই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বস্তি। চাই নিরাপত্তা, জীবনের নিশ্চয়তা, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। গুম, খুন নয়। আর কোন তরুণ প্রাণ যেন ঝরে না যায় অকালে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। আমাদের রিজার্ভ বাড়ুক। বিশ্বের সকল দেশ মহামারিমুক্ত হোক। জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা হোক সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সবক্ষেত্র নির্লজ্জ রাজনৈতিক দালালি এবং চামচাগিরি থেকে মুক্ত হোক। আমাদের তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে যাক। দেশবিদেশ জয় করে বাংলাদেশের জন্য গৌরব বয়ে আনুক। শুধু আমার নয়, আমাদের সকলের সন্তান, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন থাকে দুধে-ভাতে। শেষ পর্যন্ত চাওয়া তো খুব বেশি নয়। এটুকু চাওয়া পূর্ণ হোক। প্রতিদিন প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হোক সকলের জন্য। শুভ নববর্ষ।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস