পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়ন। কৃষিতে সমৃদ্ধ এই এলাকার কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত বীজ ও কৃষি বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অনেকটা সচেতন। তাইতো কৃষিকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ এই এলাকা। এই ইউনিয়নে বয়ে চলা খালগুলোকে কেন্দ্র করেই কৃষকদের চাষাবাদ। বর্ষা মৌসুমে পানির প্রয়োজন না হলেও শুষ্ক মৌসুমে খাল থেকেই পাম্প মেশিন দিয়ে সেচ কাজ চালিয়ে থাকেন তারা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খালে পলি পড়ে নাব্যতা কমে যাওয়ায় পানির সংকটে পড়ছেন কৃষকরা।
নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কৃষকরা শীত মৌসুমে যেমন শিম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজি উৎপাদন করেন তেমনি বর্ষা মৌসুমেও তারা করলা, বরবটি, লাউ, মিষ্টিকুমড়া থেকে শুরু করে সবধরনের লতা জাতীয় সবজি চাষাবাদ করেন। এছাড়া গাজর, শসা থেকে শুরু করে বিদেশি রেডবিট, ক্যাপসিকাম, ব্রোকলিও চাষ করেন। এমনকি অসময়ে টমেটো, কাঁচামরিচ এবং বোম্বাই মরিচ চাষ করেও কৃষকরা সফলতার মুখ দেখেছেন। আর এসব কারণে প্রতিবছর এখানকার উৎপাদিত কৃষি পণ্যের বাজার কয়েকশ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
সম্প্রতি নীলগঞ্জ ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, ইউনিয়নের প্রধান খাল ‘পাখিমাড়া’র বুকে জেগে উঠেছে বিশাল একটি চর। চরের দুই পাশেও খুব বেশি পানি নেই। সহজেই খালের এই পাড় থেকে ওই পাড়ে যাচ্ছে মানুষ। আর জেগে ওঠা চরকে বানানো হয়েছে ফুটবল খেলার মাঠ। মূল খালের যখন এমন অবস্থা তখন শাখা খালগুলোর অবস্থা আরও বেহাল। কোথাও একটু পানি নেই। ফসলের জমির পাশপাশি খালের মাটিও ফেটে চৌচির। ফলে কৃষকদের এখন হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
আরও পড়ুন- মাতৃভাষা হারাতে বসেছে ওরা
নীলগঞ্জের জনপ্রিয় কৃষক ‘লুঙ্গি জাকির’ বলেন, আগে থেকে খালে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে এরপর আর কোনো সংস্কার করা হয়নি। পাখিমাড়া খালের দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৫শ ফিট। এই খালে ১৩টা স্লুইচ গেট আছে যার অধিকাংশই অকেজো। জোয়ারের সময় পলি মাটি ঢুকে খালের নাব্যতা কমে গেছে। গত কয়েক বছর থেকে আমরা বোরো আবাদ শুরু করেছি। এরপর থেকেই পানি নিয়ে আমাদের এই সংকটের মাত্রা বেড়েছে। আমাদের এলাকায় কমপক্ষে ১৫শ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে মূলত এই খালের পানির ওপর নির্ভর করে। আমাদের এই খালটি যদি খনন করে দেওয়া হতো তাহলে চাষাবাদ আরও বাড়ানো সম্ভব হতো।
তিনি আরও বলেন, কিছু প্রভাবশালী মহল আছে যারা এই অল্প পানিতেও খাল লিজ নেওয়ার নামে মাছ শিকার করে। এতে করে তারা যখন জাল টানে তখন খালের নিচের স্তরে থাকা লবণ পানির সঙ্গে উপরের স্তরের মিষ্টিপানি মিশে যায়। আর সেই পানি যখন ফসলে দিই তখন ফসল পুড়ে যায়।
মজিদপুর গ্রামের কৃষক নেছার উদ্দিন বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে খালগুলো পুনঃখনন করে সেগুলো কৃষকের ব্যবহার উপযোগী রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই এসব খাল প্রভাশালীদের কাছে ইজারা দেওয়া ঠিক হবে না। সরকারের যদি টাকার প্রয়োজন হয় আমরা কৃষকরা প্রয়োজনে চাঁদা তুলে ইজারার টাকা পরিশোধ করবো।
আরও পড়ুন- কুয়াকাটা সৈকতে ‘মৎস্যকন্যা’
নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমাড়া গ্রামের আদর্শ কৃষক সুলতান গাজী বলেন, খালই হচ্ছে আমাদের জীবন। আমরা যত প্রযুক্তি ব্যবহার করি না কেন, পানি ছাড়া আমাদের কিছুই করার ক্ষমতা নেই। আমাদের এ অঞ্চলেতো কোনো গভীর নলকূপ নেই, খালের পানির উপর আমাদের শতভাগ নির্ভর করতে হয়। ফসল কিংবা সবজি উৎপাদনের মূল উপাদান হলো পানি। পানির মজুত বড়াতে পারলে আমাদের চাষাবাদ বাড়ানো সম্ভব। সরকারের কাছে আমাদের জোর দাবি আমাদের এই পাখিমাড়া খালটি খনন করে দিক। নতুবা এই অঞ্চলের কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে যাবে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, খালে পানি না থাকায় এই এলাকার মোট আবাদী জমির ৪০ শতাংশ জমি বছরে চার থেকে পাঁচ মাস অনাবাদী রাখতে হচ্ছে। তবে এসব খাল পুনঃখনন করে কৃষকের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থাপনায় নতুন এক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
আরও পড়ুন- লাল কাঁকড়া আর পরিযায়ী পাখির দ্বীপ ‘চর বিজয়’
পটুয়াখালী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, এই এলাকার মধ্যে নীলগঞ্জ কৃষিতে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। আমরা পানির সংকটের বিষয়ে অবগত আছি। পাখিমাড়া খালসহ জেলার ১৬৫টি খালের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে এসব খালগুলো পুনঃখনন করে মিষ্টি পানির আধার হিসেবে যেন ব্যবহার করা যায় সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি।
এফএ/এএসএম