বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ছেলেমেয়েদেরকে বিয়ে দেওয়া তাদের পরিবারের জন্য এখন কমবেশি উদ্বেগের। যেসব পরিবার সেখানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন তার অভিভাবকরা এমনটাই জানিয়েছন।তারা বলছেন, পছন্দসই বাংলাদেশি পাত্রপাত্রী না পাওয়ায় সন্তানদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ছেলেমেয়েরাও বাংলাদেশি নয় এরকম কোনো বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্ত্বেও পরিবারের কাছে তা প্রকাশ করতে দ্বিধা করছে।পূর্ব লন্ডনের বাংলা টাউনে আলতাব আলী পার্কের বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছেলেন দু’জন বাংলাদেশি ব্রিটিশ। একজনের জন্ম সেদেশেই, আরেকজন মাত্র তিন বছর বয়সে ব্রিটেনে এসেছেন। এখন তাদের বয়স ৩০।তাদের মতে, এখনও বিয়ের কথা ভাবি নাই, যখন ঠিক করবো যে বিয়ে করবো তখন পাত্রী টুকাবো, বউ পেয়ে যাবো ইনশাল্লাহ। মেয়েটি বাংলাদেশি বা ইংরেজ যে কোনো দেশেরই হোক না কেনো তার আপত্তি নেই। কিন্তু তাকে মুসলমান হতে হবে।আরেকজন বললেন, ঘরে তার বিয়ের কথা হচ্ছে কিন্তু পছন্দমতো পাত্রী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার অভিভাবকরা চান বাংলাদেশি মেয়ে এবং অবশ্যই মুসলিম।এরকম বেশ কয়েকজন অভিভাবক আমাকে তাদের ছেলেমেয়েদের সিভি দিয়েছেন। খোলামেলাভাবেই বলেছেন তাদের দুশ্চিন্তার কথা। লোকলজ্জার ভয়ে তারা নাম বলতে চাননি।এরকম একজন মা, ৪০ বছর ধরে আছেন ব্রিটেনে, তার দুই মেয়ের জন্যে বহু বছর ধরে পাত্র খুঁজছেন। তাদের বয়স ৩৪ আর ৩২।তিনি জানান, দুশ্চিন্তায় প্রায়শই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভালো পাত্র পাওয়া খুব কঠিন। ১০ বছর ধরে খুঁজছি। কিন্তু কোথাও মেলাতে পারছি না। যারা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেন তাদের অসুবিধা নাই কিন্তু যাদের জন্যে ছেলেমেয়ে খুঁজতে হয় তাদের বিয়ে দেওয়া খুব কঠিন।বাবা মায়েরা আগে ছেলেমেয়েদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিতেন। তারমধ্যে কিছু আছে জোরপূর্বক বিয়ে। কিন্তু সেসব বিয়ের অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো না হওয়ায় পিতামাতারাও এখন আর সেধরনের বিয়েতে আগ্রহী নন।ব্রিটেনে একটি কলেজের শিক্ষক রেহানা বেগম এসব পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়ে লেখালেখি করেন। তিনি বললেন, দেশে অনেক আত্মীয় স্বজন থাকায় বিয়েটা কোনো সমস্যা নয়, কিন্তু এখানে অপশন খুব কম। বহু ছেলে মেয়ে আছে যাদের বয়স হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না। তাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি।কারণ হিসেবে তিনি জানান, বাংলাদেশি মেয়েরা পড়ালেখা ও চাকরিবাকরিতে ছেলেদের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। ফলে মেলানো যায় না।ষাটের দশকে এদেশে এসেছেন এরকম একজন, নাম বলতে চাননি, একটি লোকাল কাউন্সিলে বহু বছর ধরে কাজ করছেন, নিজের ছেলেমেয়েদের সবাইকে বিয়েও দিয়েছেন, ভারতীয় এক মেয়ের সাথে এমাসেই বিয়ে হয়েছে ছোট ছেলের, তারা এখন হানিমুনে।তিনি বললেন, বাংলাদেশি অভিভাবকরাও নিজের দেশের বাইরে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে চান না। এটাও একটা সমস্যা। বিয়ের ব্যাপারে আমরা থানার বাইরে যেতে চাই না, তারপরে জেলার বাইরেও যেতে চাই না। যেতে চাই না দেশের বাইরেও, ফলে বাজারটা অত্যন্ত ছোট আর সীমিত হয়ে গেছে।বিয়ের এই সমস্যাকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে গড়ে উঠেছে বহু প্রতিষ্ঠান যারা ঘটকালি করেন। পূর্ব লন্ডন মসজিদে এরকম একটি সংস্থা আল ইহসান ম্যারেজ ব্যুরো। সেখানে যাওয়ার পর আধ ঘণ্টার মধ্যেই বেশ কয়েকজন ফোন করে পাত্রপাত্রীদের ব্যাপারে খোঁজ নিলেন।আল ইহসানে রেজিস্ট্রেশন করা আছে ৭০০ এর মতো পাত্রপাত্রী, যাদের দুই তৃতীয়াংশই নারী। তাদের তালিকায় দেখা যাচ্ছে- আপনি কি ননব্রিটিশ কাউকে বিবেচনা করবেন – এই প্রশ্নে ৯৮শতাংশই বলছেন- না। কিন্তু বাংলাদেশি নন এরকম পাত্রপাত্রীর ব্যাপারে আপত্তি নেই অনেকেরই।বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ঘটক আনু মিয়া। স্থানীয় লাইব্রেরির কর্তৃপক্ষ ঘটকালি করার জন্যে তাকে সেখানে সপ্তাহে দু’দিন বসতে দিয়েছে। ১৪ বছর ধরে একাজ করছেন তিনি।তিনি জানান, ছেলেমেয়েদের সাথে অভিভাবকদের একটা গ্যাপ আছে। বাবা মায়েরা এসে ছবি নিয়ে যান, সন্তানদেরকে দেন কিন্তু তারা খুলেও দেখে না। কারণ তাদের ইতোমধ্যেই সুব্যবস্থা করা আছে।‘সুব্যবস্থা’ বলতে তিনি বলছেন যে, ইতোমধ্যেই তারা তাদের ইংরেজ পার্টনার বাছাই করে রেখেছেন যা তারা বাবা মায়ের কাছে গোপন রাখছেন।তিনি আরও জানান, বাংলাদেশি পাত্রপাত্রীর অভাবের কারণে পাকিস্তানি, আরবি ও মিশরের মুসলমানদের সাথেও বাংলাদেশিদের বিয়ে হচ্ছে। প্রচুর বিয়ে হচ্ছে ইংরেজদের সাথেও।দুই কন্যার বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা এক মা জানান, ইংরেজ হলেও আপত্তি নেই। এমনকি অমুসলিম হলেও। তবে তিনি চাইবেন তাকে যেনো ধর্মান্তরিত করা হয়।এই মায়ের পরামর্শ হচ্ছে ছেলেমেয়েরা নিজেরাই যেনো তাদের পার্টনার খুঁজে রাখেন।এ রকম আরও অনেক অভিভাবকরা জানান, বিয়ের জন্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশিদের মধ্যে সীমিত থাকলে ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি আরও প্রকট হয়ে উঠবে। আর এ কারণেই বাংলাদেশি পরিবারগুলো, অন্তত বিয়ের ব্যাপারে, যে আরও বেশি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে বাধ্য হবে সেটা নিয়ে তাদের কোনো সন্দেহ নেই। -বিবিসি