‘পাইছি! কী পাইছেন? পীর ইয়েমেনী মার্কেট।’ জনপ্রিয় অভিনেতা সুজা খন্দকার অভিনীত এই টেলিভিশন বিজ্ঞাপন চিত্রটি এক সময় দেশজুড়ে বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিজ্ঞাপনটির মতোই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের সন্নিকটে অবস্থিত এই মার্কেটটি। ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের পাশাপাশি ঢাকার বাইরের মানুষও বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে এই মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসতেন। কালের বিবর্তনে মার্কেটটির জনপ্রিয়তা এখন কিছুটা কমেছে। তবে এখনো একশ্রেণির মানুষের কাছে মার্কেটটি আবেদন রেখে চলেছে।
গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন মার্কেটটিতে নারী, পুরুষ এবং শিশুদের পোশাক পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয়। তুলনামূলক কিছুটা কম দামে এই মার্কেট থেকে পোশাক কেনা যায় বলে রাজধানীর বাসিন্দাদের একটি অংশ এখনো নিয়মিত বিভিন্ন উৎসবে এই মার্কেটে ছুটে আসেন। আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে এরইমধ্যে মার্কেটটিতে বিক্রি জমে উঠেছে।
আরও পড়ুন: তালতলা মার্কেটে বেশি চাহিদা ছোটদের পোশাকের
সরেজমিন মার্কেটটি ঘুরে দেখা যায়, নিচতলায় (আন্ডারগ্রাউন্ড) রয়েছে মূলত শাড়ি ও লুঙ্গির দোকান। এসব দোকান থেকে জাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি বিক্রি করা হয়। এর পাশাপাশি পাইকারি দামেও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে শাড়ি ও লুঙ্গি বিক্রি করা হয়। তবে কেউ চাইলে এসব দোকান থেকে এক-দুই পিস করেও কিনতে পারেন। অর্থাৎ পাইকারির পাশাপাশি খুচরা কেনারও সুযোগ আছে।
এছাড়া দুই ও তিন তলায় রয়েছে ছেলেদের শাট ও প্যান্টের পিস কাপড়, জিন্স প্যান্ট, মেয়েদের থ্রি-পিস, শিশুদের পোশাকের সমাহার। এসব দোকান থেকেও পাইকারির পাশাপাশি খুচরা বিক্রি করা হয়। ঢাকার ছোট খুচরা ব্যবসায়ীরা যেমন এসব দোকান থেকে পণ্য সংগ্রহ করছেন, তেমনি নিজেদের ব্যবহারের জন্যও অনেকে এসব দোকান থেকে পছন্দের পোশাক কিনে নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন: মানুষ খাবে নাকি নতুন কাপড় কিনবে, প্রশ্ন ব্যবসায়ীর
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মার্কেটটিতে জাকাতের জন্য ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা দামের বিশেষ ধরনের শাড়ি এবং ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা দামের বিশেষ ধরনের লুঙ্গি রয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন দামের শাড়ি ও লুঙ্গি বিক্রি করেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। এসব শাড়ি ৪০০ থেকে ১০ হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়। একইভাবে লুঙ্গি ৩০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
মার্কেটটিতে শিশুদের গেঞ্জির সেট, জিন্স প্যান্ট, টি-শাট, শার্টসহ প্রায় সব ধরনের পোশাক পাওয়া যায়। গেঞ্জির সেট ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। ফুল জিন্স প্যান্ট ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা, হাফ ও থ্রি কোয়ার্টার জিন্স ও গ্যাবাডিং প্যান্ট ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। শিশুদের শার্ট ৩০০ থেকে ৯০০ টাকা, টি-শার্ট ২০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
আরও পড়ুন: জাকাতের কাপড়ের দাম বেড়েছে
একইভাবে নারীদের থ্রি-পিস মান অনুযায়ী ৪০০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। ছেলেদের জিন্স প্যান্ট ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় ছেলেদের শাটের পিস, ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকায় ছেলেদের প্যান্টের পিস বিক্রি হচ্ছে। নারীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গজ কাপড়।
মার্কেটটির ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এখান থেকে মূলত খুচরা ব্যবসায়ীরা পাইকারি কিনে নিয়ে যান। তবে কেউ খুচরা কিনতে এলে তাকেও ফেরানো হয় না। দোকানে থাকা পণ্যের ভেতর থেকে যে কেউ পছন্দ অনুযায়ী বেছে মাল কিনতে পারেন। সেক্ষেত্রে দাম খুব বেশি রাখা হয় না। প্রায় পাইকারি দামেই বিক্রি করা হয়।
আরও পড়ুন: হলিডে মার্কেটে জমজমাট ঈদের কেনাকাটা
ক্রেতারা জানিয়েছেন, মার্কেটটির বেশিরভাগ ব্যবসায়ী পণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি চান। তাই এখান থেকে কেনার আগে ক্রেতাদের দরদাম করে কেনা উচিত। দরদাম করে কিনতে পারলে যে কেউ এই মার্কেট থেকে পণ্য কিনে লাভবান হতে পারেন।
মার্কেটটির দ্বিতীয় তলায় জিন্সের প্যান্ট বিক্রি করা রায়হান বলেন, আমরা মূলত খুচরা বিক্রি করি। তবে কেউ চাইলে এক পিসও কিনতে পারে। আমাদের এখানে বাংলা মালের পাশাপাশি বাইরের জিন্স প্যান্টও আছে। মান অনুযায়ী এক পিস জিন্স ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি করছি। দাম যত বেশি হবে পণ্যের মান ততো ভালো হবে।
বিক্রি পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবার বিক্রি মোটামুটি ভালো। তবে খুব ভালো এটা বলা যাবে না। ঈদের পাইকারি বিক্রি এখন প্রায় শেষ। এখন খুচরা বিক্রি বেশি হচ্ছে। আমাদের ধারণা সামনের সপ্তাহ থেকে খুচরা বিক্রি আরও বাড়বে।
নিচতলায় শাড়ি বিক্রি করা মো. বিল্লাল বলেন, আমাদের দোকানে ৩৫০ থেকে ২০ হাজার টাকা দামের শাড়ি আছে। আমরা পাইকারির পাশাপাশি খুচরাও বিক্রি করি। যে কেউ আমাদের দোকান থেকে শাড়ি বাছাই করে নিতে পারেন।
আরও পড়ুন: এবার ১৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট বাজারে
বিক্রি পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সাধারণ পোশাকের পাশাপাশি জাকাতের কাপড় বিক্রি করি। এবার জাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি বেশ ভালো বিক্রি হয়েছে। এখনও টুকটাক বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সাধারণ শাড়ি, লুঙ্গি পাইকারি বেশি বিক্রি হচ্ছে। এখনও ঢাকার খুচরা বিক্রেতারা আসছেন এবং শাড়ি ও লুঙ্গি কিনছেন। ঈদ উপলক্ষে খুচরা বিক্রি আসলে সেভাবে হচ্ছে না।
শিশুদের পোশাক বিক্রি করা ইব্রাহিম হোসনে বলেন, শিশুদের পোশাকের দামের কোনো শেষ নেই। আমরা আসলে যার কাছ থেকে যা নিতে পারি। তবে কারও কাছ থেকেই খুব বেশি লাভ করি না। সাধারণত শিশুদের গেঞ্জি ও শার্টের সেট ৪০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে বিক্রি করছি। এছাড়া হাফ ও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, শুধু গেঞ্জি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বিক্রি করছি।
তিনি বলেন, অন্য যেকোনো মার্কেটের থেকে আমাদের এখানে পোশাকের দাম কম। আমরা যে মানের পোশাক বিক্রি করি, অন্য কোনো মার্কেট থেকে এই দামে পোশাক কেনা যাবে না। শিশুদের যে গেঞ্জি সেট আমরা ৫০০-৬০০ টাকায় বিক্রি করি, এই মানের গেঞ্জির সেটই পলওয়েল বা অন্য মার্কেটে দেড়-দুই হাজার টাকায় বিক্রি করে।
আরও পড়ুন: ঈদের ছুটি একদিন বাড়লো, ২০ এপ্রিলও ছুটি
বিক্রি পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এই ব্যবসায়ী বলেন, এই মার্কেট সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা ঈদের কেনাকাটা করতে আসছেন। আল্লাহর রহমতে ভালোই বিক্রি হচ্ছে। ঈদের বিক্রি কেবল শুরু হয়েছে। চাঁদ রাত পর্যন্ত এখন প্রতিদিনই ভালো বিক্রি হবে বলে আশা করছি।
মার্কেটটিতে পোশাক কিনতে আসা আমেনা বেগম নামের একজন বলেন, আমাদের বাসা যাত্রাবাড়ী। প্রায় ২০ বছর ধরে যাত্রাবাড়ীতে আছি। ঈদের কেনাকাটা সাধারণত এই মার্কেট থেকেই করি। এখানে তুলনামূলক কম দামে ভালো পোশাক পাওয়া যায়। তবে আগের তুলনায় এখন এখানে মানুষ কম আসে। তাছাড়া এখন বেশিরভাগ ব্যবসায়ী যে দামে বিক্রি করে, তার থেকে বেশি দাম চায়। তাই দরদাম করে কেনা লাগে। দরদাম করতে না পারলে এখানে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে কোনো কোনো ব্যবসায়ী এক দামেও বিক্রি করেন।
সাইফুল ইসলাম নামের আরেক ক্রেতা বলেন, এখানে যেসব পোশাক বিক্রি হয় তার বেশিরভাগই দেশি। বাইরের কিছু কিছু পণ্য আছে। তবে সেই সংখ্যা খুব কম। দেশি পণ্য হলেও এখানকার পণ্যের দাম তুলনামূলক কম। আমি শাড়ি, লুঙ্গি, শার্ট-প্যান্টের পিস নিয়মিত এখান থেকে কিনি। এছাড়া শিশুদের পোশাকও এখান থেকে কিনি। দাম ও মানে আমি সন্তুষ্ট।
এমএএস/এসএইচএস/এমএস