মেগাসিটি ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটি ছুঁই ছুঁই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ শহরে জনসংখ্যা, আকাশচুম্বি ভবন যেমন বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে সবুজ। ক্রমাগত সবুজ হারানো এই শহরের ফুসফুস হিসেবে পরিচিত রমনা পার্ক ঢাকা শহরের সবুজের এক বড় আশ্রয়। রমনা পার্কে রয়েছে প্রচুর ঘাস, লতা-গুল্ম, ছোট ও মাঝারি আকারের এবং মৌসুমী ফুলে সমৃদ্ধ গাছ। বেশ কিছু দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষও রয়েছে এ পার্কে। প্রচুর গাছগাছালির কারণে রমনা পার্কে পাখির আনাগোনাও থাকে বছরজুড়ে চোখে পড়ার মতো। রাজধানীর অধিকাংশ পার্কই মাদকসেবী, যৌনকর্মী, ছিন্নমূল মানুষ, হকার, ধান্দাবাজদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হলেও রমনা পার্কের পরিবেশ সেই অর্থে তুলনামূলক ভালো। নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সকাল-বিকেলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজারো রমনা পার্কে আসেন শরীর চর্চা করতে। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিক কর্মসূচিসহ অপরিকল্পিত কনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে এর অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন পরিবেশবিদরা। তাদের অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রমনা বটমূল ব্যতীত সম্পূর্ণ পার্ক জুড়ে অনুষ্ঠান পার্কের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে, পার্কে অব্যাহতভাবে বিবিধ কনস্ট্রাকশন সবুজকে বিনষ্ট করছে, পার্কে ফুলজ ও নান্দনিক গাছের বদলে বনজ ও ফলদ গাছের বিস্তার বাড়ছে; যা পার্ক হিসাবে রমনার সৌন্দর্য উপযোগিতা ও ঐতিহ্যকে ব্যাহত করছে, বৃক্ষশোভিত স্থান ও ঘাসে ঢাকা উন্মুক্ত স্থানে এবং লনে অপরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো হচ্ছে।এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ‘রমনা পার্ক: সৌন্দর্য, উপযোগিতা ও ঐতিহ্য সুরক্ষা’ শীর্ষক এক সেমিনারে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা রমনা পার্কসহ সকল উদ্যান রক্ষা করতে চাই। রমনা পার্ক সংরক্ষণে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে এবং উক্ত কমিটির মতামতের ভিত্তিতে রমনা পার্ক সংরক্ষণ করা হবে।তিনি জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়া হবে না। পার্ক হিসেবে রমনার সৌন্দর্য-ঐতিহ্যের ক্ষতি প্রসঙ্গে স্থপতি তুগলক আজাদ বলেন, এমনিতেই মহানগরীর বেশির ভাগ মাঠ ও পার্ক বেদখল হয়ে যাওয়াতে সাধারণ মানুষের বেড়ানো, শরীরচর্চার স্থান সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। তাই ঢাকাবাসীর শ্বাস গ্রহনের ফুসফুসসম এই নান্দনিক স্থানটি থেকে সাধারণ মানুষ যেন কোনোভাবেই বঞ্চিত না হন, সেটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশবিদদের অভিযোগের বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, এই পার্ক রক্ষার জন্য যা যা করা দরকার সকলের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা অচিরেই সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেব। পার্ক সংরক্ষণে কমিটি গঠন করা জরুরি জানিয়ে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, বাংলাদেশের উদ্যান ও পার্ক সংরক্ষণের জন্য একটি পলিসি দরকার। কোনো কাগুজে কমিটি নয়, প্রয়োজন ক্ষমতাসম্পন্ন সমন্বয় কমিটি।রমনা পার্কের সৌন্দর্য-ঐতিহ্য রক্ষায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি কতটা কার্যকরী হবে- এ বিষয়ে প্রকৃতিবিদ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বলেন, রমনা পার্ক রক্ষায় সরকারের সকল পদক্ষেপে আমরা সহযোগিতা করতে আগ্রহী। আমরা আশা করবো, একে যথাযথ সংরক্ষণের জন্য সরকার সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, প্রকৃতির দানগুলোকে যে কোনো উপায়ে রক্ষা করতে হবে। পার্ক ও উদ্যানের সৌন্দর্য নগরীর বাসিন্দারা যাতে বাইরে থেকেও উপভোগ করতে পারেন, এজন্য সীমানা প্রাচীরগুলো স্বচ্ছ রাখতে হবে। উদ্যান ও পার্কের চারপাশে কোনো সুউচ্চ ভবন নির্মাণ যাতে না হয়, এটি নিশ্চিত করতে হবে।এএস/এনএফ/এমএস