সংসার করার প্রবল ইচ্ছে ছিল। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করতে হতো। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে আর সংসার করা হয়ে উঠেনি। সব ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে বাবার বাড়িতে। নির্যাতনের বিভিষীকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন শাকিলা আক্তার শান্ত (২৪)। ছোট মেয়েকে নিয়ে বিধবা মায়ের সঙ্গে নওগাঁ সদর উপজেলার দেবীপুর উড়াপাড়া গ্রামে এক কুড়ে ঘরে বসবাস করেন শাকিলা আক্তার।নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ এবং বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর নওগাঁ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ৫টি ক্যাটগরিতে জেলার ৫ জন জয়িতাকে ক্রেস্ট, সদন ও স্মারক প্রদান করা হয়। শাকিলা আক্তারও ছিলেন তাদের মধ্যে একজন।জন্মের ১৩ দিন পর বাবা মারা যান। সেই থেকে দুই ভাইয়ের কাছে বড় হয়েছেন শাকিলা আক্তার। ইচ্ছে ছিল পড়াশুনা করে দেশের জন্য কিছু করার। কিন্তু অভাবের সংসার হওয়ায় এসএসসি পরীক্ষার আগে ১৪ বছর বয়সে ভালো পরিবার দেখে বোনকে বিয়ে দিলে সুখে থাকবে এই আশায় ২০০৫ সালে পরিবারিকভাবে বিয়ে হয় পাশের কাঁদোয়া গ্রামের ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি সাজেদুল ইসলামের সঙ্গে। কিন্তু ভালো থাকা হলো না শাকিলা আক্তারের।বিয়ের সময় ৫০ হাজার টাকা যৌতুক এবং ঘর সাজানোসহ নগদে বিভিন্ন উপঢৌকন দিতে হয়েছিল। বিয়ের কয়েক দিন পর থেকে শুরু হয় স্বামীসহ পরিবারের লোকজনের নির্যাতন। এভাবেই কেটে গেছে গত দশ বছর। আর এর মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক ছেলে ও ২ মেয়ে।শাকিলা আক্তার জানান, বিয়ের পর বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের পরিমাণটা এমন ছিল যে এক সময় অজ্ঞান হয়ে যেতাম। আমার স্বামী নেশা করে প্রতি রাতে বাড়ি ফিরত। প্রতিবাদ করলেই শুরু হতো নির্যাতন। এছাড়া শ্বশুর বাড়ির লোকজনও নির্যাতন করতো। নির্যাতনের কথাগুলো বলার সময় চোখ দিয়ে পানি আর ধরে রাখতে পারলেন না শাকিলা। তিনি বললেন, ২০১২ সালের একদিন রাতে বাড়িতে ফিরে লাঠি দিয়ে মারপিট করে আমার স্বামী। পরে মেরে ফেলা উদ্দেশ্যে মুখে বালিশ চাপা দেয়। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলে ঘরের বাইরে রেখে দেয়। খবর পেয়ে সকালে আমার মা আমাকে নিতে গেলেও শ্বশুর বাড়ির লোকজন ছেড়ে দেয়নি। মা চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ দিলে থানা পুলিশের মাধ্যমে আমাকে উদ্ধার করে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ৫দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। শাকিলা আরো জানান, এরপর গ্রাম্য বিচারে স্বামী আর নির্যাতন করবে না বললে আবার স্বামীর বাড়িতে ফিরে যায়। কিন্তু কিছুদিন পর আবারও শুরু। ২০১৪ সালের একদিন প্রচণ্ড নির্যাতনের পর বড় ভাইকে ডেকে এনে আমাকে নিয়ে যেতে বলে। আর আমার সাথে সংসার করবে না বলেও জানিয়ে দেয়। ভাইয়ের বাড়িতে এসে ২০১৪ সালে নওগাঁ নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতে মামলা করা হয়। আমাকে তালাক দিয়ে তা গোপন করে রেখেছিল স্বামী সাজেদুল ইসলাম। মামলা করার পর তালাক নামা কোর্টে পেশ করে। তিনি আরও বলেন, গত দেড় বছর থেকে সামান্য বেতনে স্থানীয় একটি এনজিও “ডুয়েল মাল্টিপারপাস” এ চাকুরি করছি। এটা করেই ছোট মেয়েকে নিয়ে মার সঙ্গে কোনো রকম জীবন যাপন করছি। বড় ছেলে ও মেয়েকে তার কাছেই রেখেছে। ভাইদের বাড়ির জায়গা জমি তেমন না থাকায় গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি পালন করতে পারছিনা।কোনো মেয়ে যেন আমার মতো নির্যাতনের শিকার না হয়। আমি চাইবো তার যেন সঠিক বিচার হয়। কিছু হোক বা না হোক তার যেন সাজা হয়। অর্থ, সামাজিক ও মানুষিক সব দিক দিয়ে সাধারণ জীবন যাপন করছি। নির্যাতনে সব বিভিষীকা মুছে নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে চলার প্রত্যাশায় আছি। শাকিলার বড় বোন শ্যামলি আক্তার জানান, দুবাই যাবে বলে ২ লাখ টাকার জন্য ছোট বোনকে বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন করা হতো। গরীব বলে আমাদের পক্ষে এতো টাকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। মামলার পর আদালত থেকে তদন্ত হলেও গরীব বলে কোনো সুষ্ঠ বিচার পাইনি। তাদের পরিবার থেকে বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকিও দেওয়া হয় ভাইদের মেরে ফেলার জন্য। তার মামাতো বোনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় আমার বোনের উপর এ নির্যাতন করা হতো। আমার বোনকে তালাক দেওয়ার পরই তার মামাতো বোনকে বিয়ে করে সংসার করছে।জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, এতো নির্যাতন সহ্য করে যে নারী বেচেঁ আছে এটাই বড় কথা। হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারতো। নির্যাতনে বিভিষীকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছে। প্রতি বছরই জেলা পর্যায়ে জয়িতাদের পুরস্কৃত করা হয়। গত বছর জেলার ১১টি উপজেলা থেকে প্রায় ২ শতাধিক নারী আবেদন করেছিল। সেখান থেকে জেলা পর্যায়ে ৫ জনকে জয়িতা ঘোষণা করা হয়।এফএ/এমএএস/এবিএস