মতামত

পাকিস্তান: যে রাষ্ট্র সেনাবাহিনীর জন্য

পাকিস্তান: যে রাষ্ট্র সেনাবাহিনীর জন্য

একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তার নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয় সেনাবাহিনীর। যার মূল কাজ থাকে সেই রাষ্ট্রের জনগণের জান-মালের হেফাজত করা ও সীমান্ত রক্ষা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের জন্য, রাষ্ট্রের জনগণের জন্য সেনাবাহিনী। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর একমাত্র ব্যতিক্রমী দেশ সম্ভবত পাকিস্তান। যেখানে রাষ্ট্র ও তার জনগণ সেনাবাহিনীর জন্য। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ইচ্ছে পূরণ, তাদের ক্ষমতা বজায় রাখা এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য যেন গঠিত হয়েছে পাকিস্তান। যেখানে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সামরিক শাসন থাকলেও এখন পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক সরকার পূর্ণ মেয়াদে থাকতে পারেনি ক্ষমতায়।

Advertisement

পাকিস্তানে কোন প্রধানমন্ত্রী পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকেনি, এটি যেমন সত্য। তেমনিভাবে এটিও সত্য যে, ইমরান খান পাকিস্তানের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী নন যাকে সামরিক বাহিনীর ইন্ধনে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের ভাষ্যমতে ইমরান খানকে আইন ও বিচার ব্যবস্থার তোয়াক্কা না করে হঠাৎ গ্রেফতারের মূল কারণ গত ৬ মে লাহোরে একটি সমাবেশে দেয়া তার ভাষণ। যেখানে তিনি পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) এর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসিরের বিরুদ্ধে তাকে দুবার হত্যার চেষ্টার অভিযোগ তোলেন। এর আগেও বিভিন্ন সময় তার সরকার পতনের জন্য ইমরান খান সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছিলেন, তৎকালীন সেনা প্রধানের নির্দেশক্রমেই তিনি সংসদ ভেঙ্গে দেন। তবে সরাসরি সেনাবাহিনীতে কর্মরত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগের পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সরাসরি অবস্থান নিতে দেখা যায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে বিবৃতিও প্রদান করা হয়। শুধু সেনাবাহিনী থেকে নয়, দেশটির বর্তমান সরকারও সেনাবাহিনীর সুরে সমালোচনা করে ইমরান খানের।

যা বলছিলাম আগেই, ইমরান খান পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কারণে গ্রেফতার হওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী নন। বরং এই তালিকা বেশ দীর্ঘ। পাকিস্তানের প্রথম গ্রেফতার হওয়া প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৬২ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার কারণ, তিনি জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলকে সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানান। তাকে শুধু গ্রেফতারই করা হয়নি এ সময়, বরং তাকে ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অভিযোগের বিচার ছাড়াই করাচীর নির্জন কারাগারে রাখা হয়। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে আনা হয় 'রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের' অভিযোগ।

১৯৭০ এর নির্বাচনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। কার্যত তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যই নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তাকেও কিন্তু গ্রেফতার করা হয়। শুধু গ্রেফতারই নয়, তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে সুসংগঠিত বিচার কার্যক্রম ছাড়াই বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। যদিও শেষ পর্যন্ত তা আর কাজ করেনি বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের কারণে। কিন্তু এই নির্বাচনের ফল ধরে বিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি খাজা মোহাম্মদ আহমদ সামদানি তাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই বিচারপতি বলেছিলেন, তাকে গ্রেপ্তারের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। কিন্তু মার্শাল ল রেগুলেশন-১২'র অধীনে ৩ দিন পরে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়েছিল। আইনটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সুরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা বা সামরিক আইনের সুষ্ঠু পরিচালনার বিরুদ্ধে কাজ করে এমন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়। এই আইনকে কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না! অর্থাৎ এমন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে সেনাবাহিনীর আইন সর্বোচ্চ বিচারবিভাগের ক্ষমতারও ওপরে রাখা হয়েছে। অবশেষে ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

Advertisement

পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে করাচীর এক সমাবেশে তৎকালীন সামরিক সরকারের নিন্দা করায় বেনজির ভুট্টোকেও গ্রেফতার করা হয় ১৯৮৬ সালের আগস্টে। বর্তমানে পিটিআই এর ইমরান খানের মতই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কাছে 'বিষফোড়া' হয়েছিলো বেনজির ভুট্টো। কেননা পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অবস্থান, দখল ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে জন সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি। যেমনটি এখন দেখা যাচ্ছে ইমরান খানের ক্ষেত্রে। বেনজির ভুট্টোকে যখন হত্যা করা হয়, তখন ক্ষমতায় আসীন সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ। সামরিক শাসক হয়েও তিনি তার পূর্বসূরি আইয়ুব খান এবং বাংলাদেশের জিয়াউর রহমানের মতই ক্ষমতা দখলে বেশ পটু ছিলেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর তিনি যখন দেশটির রাজনীতির প্রতি মনোযোগী হন, তখনি বেঁকে বসে সামরিক বাহিনী। শেষ পর্যন্ত তাকেও ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। কেননা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর স্বার্থে একচুল পরিমাণ আঘাত লাগলেও তারা বিষয়টি সহ্য করেনি। এর জন্য ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে ৩০ লাখ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করতেও কুণ্ঠা বোধ করেনি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খুনিরা।

এ ছাড়াও নওয়াজ শরীফ ও শাহবাজ শরীফকেও গ্রেফতারের মুখোমুখি হতে হয়। মূলত যখন যেই নেতা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তখনি সেই নেতাকে গ্রেফতারের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে সেনাবাহিনী। আর এ কারণেই পাকিস্তানে গ্রেফতার হওয়া প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক বার গ্রেফতার করা হয় বেনজির ভুট্টোকে। ধারণা করা হচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে এই গ্রেফতার থেকে মুক্তি মিললেও আবারও গ্রেফতার হতে পারেন ইমরান খান।

১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রী যদি তার ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারতেন তাহলে ইমরান খান পাকিস্তানের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হতেন। কিন্তু, ইমরান খান ছিলেন দেশটির ২২তম প্রধানমন্ত্রী। তার একমাত্র কারণ নির্ধারিত মেয়াদের আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের নানা কারণে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে।

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন। মৃত্যুর আগে ৪ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

Advertisement

এ ছাড়াও জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার খুব কাছাকাছি ছিলেন। প্রায় ৪ বছরের বেশি সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ১৯৭৭ সালের নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন। আর দেশটির জনগণ তাকে ভোট দিয়ে বেছে নেয়ার কারণেই স্বৈরশাসক জেনারেল মুহাম্মদ জিয়া উল হক ১৯৭৭ সালে প্রথমে তাকে কারাগারে বন্দি করে এবং অনেকটা বিনা বিচারে ১৯৭৯ সালে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

এ ছাড়াও ইউসুফ রাজা গিলানি ও নওয়াহ শরীফও প্রায় ৪ বছর সময়কাল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু কোনবারই তারা মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। যেমনটা পারেননি বেনজির ভুট্টো ও বর্তমানে ইমরান খান। ১৯৪৭ সালে একদিন আগে-পরে জন্ম নেয় পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্র। যেখানে ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রয়েছে নরেন্দ্র মোদি, সেখানে পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ! পাকিস্তানে সর্বোচ্চ ৪ বছর ২ মাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। আর দেশটিতে সর্বনিম্ন ১৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন নুরুল আমিন

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নগ্ন হস্তক্ষেপের আরেকটি স্থান হলো দেশটির বিচার বিভাগ। খান মাত্র এক বছর আগে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর থেকে খান সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিবাদ মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। নভেম্বরে তাকে হত্যা প্রচেষ্টায় গুলিবিদ্ধ হন। খান আগস্টের সময়সীমার আগেই জাতীয় নির্বাচনের জন্য জোর দিচ্ছেন। তার দল জানুয়ারিতে পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়া দু’টি প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেয়। প্রাদেশিক নির্বাচন ঐতিহ্যগতভাবে জাতীয় নির্বাচনের সাথে যৌথভাবে অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধান অনুসারে পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনে, দু’টি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন তাদের নিজ নিজ বিলুপ্তির ৯০ দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) এই সময়সীমা মেনে নিতে অস্বীকার করে। সামরিক বাহিনী বলছে যে, তারা পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবে নির্বাচনের নিরাপত্তা দিতে অক্ষম।

সরকার ও সামরিক বাহিনী নির্বাচন না করার প্রচেষ্টার কারণে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করেছে এবং গত মাসে একটি সুয়োমোটো নোটিশ নিয়েছে, পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা ব্যবহার করে। আদালত এটির ওপর শুনানি শুরু করে। কিন্তু আদালত নিজেই বিভক্ত হয়ে পড়ে। সরকার সামরিক বাহিনীর সাহায্যে এখন সুয়োমোটো ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সংসদে একটি বিল পাস করেছে এবং শীর্ষ আদালতের কিছু বিচারক এই প্রস্তাব সমর্থনও করছেন। অর্থাৎ শুধু রাজনীতিই নয়, সমাজও গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে এবং তাদের মধ্যে একটি কুৎসিত লড়াই শুরু হয়েছে। দেশের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী সঙ্কট তৈরি করছে। বর্তমানে পাকিস্তান একটি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক সঙ্কটের সম্মুখীন। জনগণ এবং সরকার ও সামরিকজান্তার মধ্যে বিভাজন শুরু হয়েছে। বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন যে, আর্থিক ভাঙনের সাথে বিচার বিভাগ, রাজনীতি ও সাংবিধানিক সঙ্কট নিমজ্জিত হওয়ার সাথে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বাড়বে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের একজন ফেলো মাদিহা আফজাল সতর্ক করেছেন, ‘সঙ্কট গভীরতর হচ্ছে এবং এটি থেকে উত্তরণের পথ খুবই কঠিন।’ ডিডব্লিউকে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের সব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিগ্রস্ত- সামরিক, আইনসভা ও বেসামরিক সরকার, বিচার বিভাগ। সামরিক এবং বিচার বিভাগ উভয়ই সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক এবং মেরুকরণ করা হয়েছে; তাদের প্রতি জনগণের আস্থা নেই।’

বর্তমান পরিস্থিতিতে, পাকিস্তানের বিচার বিভাগ সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে আইন প্রণেতা এবং নির্বাহী শাখার মধ্যে বিরোধের সমাধান করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটিও অনিশ্চিত। ইসলামাবাদের আইন বিশেষজ্ঞ ওসামা মালিক ডিডব্লিউকে বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে তারা চরম ব্যর্থ এই চূড়ান্ত মুহূর্তে।’ খানের পিটিআই দল বলছে, সঙ্কট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সাংবিধানিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা। জনগণ বর্তমান সরকারকে মেনে নিচ্ছে না যারা শুধু স্বৈরাচারের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছে। সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে চায় এবং শাসক জান্তার প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে।

শুধু সম্প্রতি সময়েই নয়, পাকিস্তানের সব কয়টি সামরিক শাসনকে সে দেশের বিচার বিভাগ বৈধ বলে রায় দিয়েছে। ১৯৫৪ সালে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পার্লামেন্টে ভেঙে দিলে, স্পিকার তমিজউদ্দিন যে কেস করেছিলেন, সে কেসের রায়ে সিন্ধু হাইকোর্ট পার্লামেন্ট ডিসলভকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি জাস্টিস মুনিরের নেতৃত্বে ফেডারেল কোর্টে ওই রায় উল্টে দেওয়া হয়।

এ জাস্টিস মুনিরই সামরিক অভ্যুত্থান একটি ইন্টার ন্যাশনাল মেথড বা হ্যনস কেলসেনের ‘ডকট্রিন অফ নেসেসিটি’ বলে ১৯৫৮ এর সামরিক শাসনকেও বৈধ বলে ঘোষণা করেছিলেন। জিয়াউল হকের সামরিক অভ্যুত্থানকে পাকিস্তান কোর্ট, রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও জনগনের কল্যাণ- বলে বৈধতা দিয়েছিল। আবার পারভেজ মোশারফের 'ক্যু' কে ‘ডকট্রিন অফ নেসেসিটি’ বলা হয়েছিল। এ ছাড়া আরও একটি সত্য হলো, সেদিন কোর্টের মাধ্যমে নেওয়াজ শরীফকে শাস্তি দিতে না পারলে ইমরান খানের নির্বাচনে ওই ১৫৫টি সিট পাওয়া বাস্তবে কোনো মতেই সম্ভব ছিল না।

সুতরাং এটি স্পষ্ট, সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান। আবার সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বেই তাকে ক্ষমতা ত্যাগ করতে হয়। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী রাজনীতিবিদদের ধারধারেনি। তারা নিজেদের মত করেই সকল সিদ্ধান্ত নিতো। আর এ বিষয়টিকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা হিসেবেই বর্ণনা করেছেন বিশ্লেষকেরা।

প্রকৃত অর্থে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অধিকার আদায়, রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং বলিষ্ঠভাবে জনমত তৈরির জন্য বরারবরই এগিয়ে ছিলো বাংলাদেশ। ব্যতিক্রম ছিলো না মুসলিম লীগের রাজনীতিতেও। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর অঞ্চলভেদে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, বিশেষত পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ক্ষমতা দখলে রাখার তীব্র ইচ্ছার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে দেশটির সেনা বাহিনী। ফলে ১৯৪৮-৪৯ সাল থেকেই সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন ছায়াতলে এগিয়ে যায় অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনীতি। কিন্তু রাজনীতিবিদদের জন সম্পৃক্ততা কাল হয়ে দাঁড়ায় তাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে এই অস্বাভাবিক সম্পর্কের জন্য। কেননা সাধারণ মানুষের স্বার্থ সর্বদা সেনাবাহিনীর স্বার্থের ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পায় না এবং পেতে পারেও না। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিজেদের যে কোন স্বার্থ আদায়ের বিষয়ে অবিচল। পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর অবস্থান এখন এমনই শক্তিশালী যে, যে কোন রাজনৈতিক দলই তাদের সাথে আপোষ না করে টিকে থাকতে পারে না। বলা হয়ে থাকে, এ পর্যন্ত দেশটির কোন প্রধানমন্ত্রী তার পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। কিন্তু সেনাবাহিনী ক্ষমতা-কাঠামোর খুব কাছাকাছি থাকলেও, দেশটিতে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে।

ঐতিহাসিকভাবে ৬০ এর দশকে এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই সামরিক বাহিনী রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসার ফলে রাজনীতি, অর্থনীতি আর সমাজের অনেক কিছুই বদলেছে। পাকিস্তানের সমাজেও ও সেই সঙ্গে রাজনীতিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ধরণেও পরিবর্তন এসেছে। এবারের সংকটের সময় ইমরান খানের সাথে দূরত্ব তৈরি হলেও, রাজনৈতিক উত্তেজনার সময় সেনাবাহিনী জানিয়ে দিয়েছিল তারা কোন পক্ষে নেই। যদিও সেটা কতদূর সত্য, তা নিয়ে রয়েছে হাজার হাজার সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে পাকিস্তানের তরুণ সমাজ দেশটির সামরিক বাহিনীর অনৈতিক কার্যক্রমগুলো সম্পর্কে জানতে পারছে এবং তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে। সেনা বাহিনীর প্রতি এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই আমরা দেখলাম বিগত দিনগুলোতে ইমরান খানকে গ্রেফতারের পর। কিন্তু আসলেই কী পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তার ক্ষমতাকে খর্ব হতে দেবে? আসলেই কী জনগণের হাতে ক্ষমতা যাবে?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস