দেশজুড়ে

খুঁটিতে বাঁধা তায়িবার জীবন, অর্থাভাবে হচ্ছে না চিকিৎসা

ঘরের বারান্দায় খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে ফুটফুটে এক শিশুকে। এ দৃশ্য দেখে যে কারও মনে হবে ওই শিশুটিকে নির্যাতন করা হচ্ছে। কিন্তু না! বাঁধন খুলে দিলেই নিজের শরীরে নিজেই অনবরত আঘাত করতে থাকে বাকপ্রতিবন্ধী তায়িবা। তাই বাধ্য হয়ে তাকে এভাবে বেঁধে রাখা হয়।

নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের লেটিরকান্দা গ্রামের মাহফুজুর রহমান নয়ন ও আঁখি আক্তারের কন্যাসন্তান তায়িবা আক্তার। শিশুটির বয়স এখন আট বছর। তবে জন্মের পর থেকেই তার এমন বন্দি জীবন। অসুস্থ বাবা অর্থাভাবে শিশুটির চিকিৎসা করাতে না পারায় প্রতিদিনই এভাবে কষ্ট পাচ্ছে তায়িবা।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, তায়িবা কথা বলতে পারে না। বেশি মানুষ দেখলেই তার চোখে-মুখে হিংস্রতা ফুটে ওঠে। হাত-পা খোলা থাকলে নিজেই নিজের মুখে ও মাথায় অনবরত আঘাত করতে থাকে। দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। বাঁশঝাড়ের নিচে ছোট্ট একটি ভাঙাচোরা ঘরের বারান্দার খুঁটির সঙ্গে তায়িবার পা বেঁধে রাখা হয়েছে। এছাড়া দুই হাতও একটি কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

তায়িবার বাবা মাহফুজুর রহমান নয়ন মেয়েকে দেখাতে হাতের বাঁধন খুলে দেন। এসময় তায়িবা দুই হাতে মুখের দুইপাশে সজোরে অনবরত আঘাত করতে থাকে। অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে। বিষয়টি আশপাশের লোকজনও জানেন। তাই সজোরে চিৎকার করলেও কেউ দেখতে আসে না। বিষয়টি যেন চারপাশের সবারই গা সওয়া হয়ে গেছে।

তায়িবার মা আঁখি আক্তার বলেন, দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তায়িবা সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই প্রতিবন্ধী ভাব তার স্বভাবে থাকলেও তা পুরোপুরি প্রকাশ পায়নি। মাঝে মধ্যেই সে অসুস্থ থাকতো। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে থাকে।

আদরের মেয়ের এমন কষ্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে অঝোরে কাঁদেন আঁখি আক্তার। তিনি বলেন, তায়িবা কথা বলতে পারে না। যখন যা মন চায় তাই করতে থাকে। শক্ত বস্তুতে নিজের মাথা ঠুকতে থাকে। তখন থেকে তাকে বেঁধে রাখতে শুরু করি। কিন্তু গাছের সঙ্গে এক হাত বা এক পা বেঁধে রাখলে নিজের মাথা গাছের সঙ্গে ঠুকতে থাকে সে। তাই দুই হাত টানা দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়।

শিশুটির মা বলেন, ঘুমের ওষুধ ছাড়া কখনো রাতে ঘুমায় না তায়িবা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর পর রাতে বিছানায় হাত-পা বেঁধে রাখা হয়। কারণ তায়িবা মধ্যরাত থেকে আর ঘুমায় না। ওই সময় সে যেন কোনো দুর্ঘটনা না ঘটাতে পারে পারে তাই সব সময়ই বেঁধে রাখা হয়।

তায়িবার বাবা মাহফুজুর রহমান নয়ন পেশায় দিনমজুর। তিনি পা এবং কোমরে জটিল রোগে আক্রান্ত। অসুস্থ শরীর নিয়ে সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে কোমরে বেল্ট লাগিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করেন।

শিশু তায়িবার বাবা জানান, বাড়ি ভিটার সাত শতাংশ জমি ছাড়া তার কোনো জমিজমা নেই। বড় ভাইয়ের চালাঘরে তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। নিজের থাকার ঘরও নেই। অভাবের তাড়নায় অসুস্থ শরীর নিয়েও কাজ করতে হয় তাকে। এ অবস্থায় তায়িবা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ায় দুশ্চিন্তায় দিন কাটে তার।

নয়ন বলেন, নিজের সন্তানকে এভাবে বেঁধে রাখা কী যে কষ্ট! তা কাওকে বোঝাতে পারবো না। এর আগে কষ্ট করে কিছু টাকা মিলিয়ে ঢাকায় চিকিৎসা করানো হলেও পরবর্তীতে টাকার অভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। চোখের সামনে মেয়ের এমন যন্ত্রণাময় জীবন দেখে সহ্য করা কঠিন।

প্রতিবেশী জায়েজুল ইসলাম বলেন, নয়নের পরিবারটি অত্যন্ত অসহায়। তাদের কন্যা তায়িবাকে বেশ কয়েকবছর ধরে বেঁধে রাখতে হয়। তায়িবা নিজেই নিজের শরীরে আঘাত করে। সুযোগ পেলেই দৌড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। একবার হারিয়েও গিয়েছিল। লোকজন এসে বাড়িতে দিয়ে গেছে। অর্থাভাবে তায়িবাকে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেনি তার বাবা।

পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জাহিদ হাসান প্রিন্স বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। খোঁজ নিয়ে উপজেলা প্রশাসন শিশু তায়িবার পাশে দাঁড়াবে।

এইচ এম কামাল/এমআরআর/এএসএম