ঋণ দেওয়ার সময় গ্রাহকের কাছ থেকে জমির দলিল কিংবা ব্ল্যাংক চেক নিয়ে থাকে জয়পুরহাটের অধিকাংশ এনজিও। পরে কিস্তি দিতে না পারলেই গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানির করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া এনজিওর ঋণের চাপে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে জেলায়। সেইসঙ্গে কয়েকটি এনজিও আবার গ্রাহকে সঞ্চয়ের কোটি কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে।
কয়েকমাস আগে সদর উপজেলার চকদাদরা গ্রামের রাসেল হোসেন ‘গ্রাম বিকাশ’ নামে একটি এনজিও থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি মুরগির ব্যবসা শুরু করেন। এর মাঝে তিনি তিনটি মাসিক কিস্তিও দিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করে মুরগির ব্যবসা ভালো না যাওয়ায় একটি কিস্তি দিতে পারেননি।
রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, আমি ওই একটি কিস্তি না দিতে পারায় এনজিওর লোকজন রাত ১০টার দিকে আমার বাসায় এসে মানসিক টর্চার শুরু করে। একপর্যায়ে আমার কাছ থেকে ফাঁকা কাগজে সই নেয়। এর তিনদিন পর আমার বাসায় পুলিশ আসে। পুলিশ দেখে বাড়ির লোকজন সবাই ভয় পেয়ে যাই। পরে জানতে পারলাম যে, এনজিও থেকে আমার বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যদি এরকম ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে হয়রানির শিকার হই তাহলে যাব কোথায়?
জয়পুরহাট শহরের নতুনহাট এলাকার ফরিদা বেগম জানান, তিনি ‘পল্লীমঙ্গল কর্মসূচি’ থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। সেই ঋণ নেওয়ার সময় তার কাছ থেকে জমির দলিল এবং ব্যাংকের ফাঁকা চেক নেওয়া হয়।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, একটা কিস্তি যদি কোনো কারণে না দিতে পারি তাহলে এনজিওর লোকজন বাড়িতে এসে নানারকম ভয়ভীতি দেখায়। আবার বাসায় এসে বসে থাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গ্রাহক জানান, তিনি স্থানীয় এনজিও ‘এসো’ থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। তখন তার কাছ থেকে ছবি, ভোটার আইডির ফটোকপিসহ ব্ল্যাংক চেক নেওয়া হয়। সমস্যার কারণে তিনি কিস্তি দিতে না পারায় তার নামে এনজিওটি মামলা করেছে।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এই এসো থেকে লোন নিয়ে কিস্তি না দিতে পারায় যখন এনজিও থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয় তখন অনেকেই ঢাকায় পালিয়ে যান।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার গোবিন্দপুর, গংগাদাসপুর, মুরারী, হাতিগাড়া, জলাটুল, পাঁচবিবি উপজেলার বাগজানা, উচাই, সমস্যাবাদ, কালাই উপজেলার সিলিমপুর, বিয়ালা, মাত্রায়, উদয়পুর, ক্ষেতলাল উপজেলার বটতলী, ইটাখোলা, মুনঝার, ঝামুটপুর আক্কেলপুর উপজেলার পশ্চিম শিয়ালাপাড়া, রায়কালীসহ ২০টি গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওইসব এলাকা থেকে শতাধিক পরিবার ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করতে পেরে এনজিওর ভয়ভীতি ও মামলার চাপে এখন ঢাকায় অবস্থান করছে।
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের করমজি গ্রামে রোজিনা (৩২) নামে এক নারী এহেড সোশ্যাল অরগানাইজেশন ‘এসো’ নামে একটি এনজিও ঋণের চাপে আত্মহত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিহত রোজিনার মা ছালমা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, আমার স্বামী কলিমদ্দিন তিন বছর আগে ছেলেমেয়ের নামে এসো এনজিওর তিলকপুর শাখা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে উধাও হয়ে যায়। ওইসময় থেকে ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য আমার ছেলে সুমন ও মেয়ে রোজিনার ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে ওই এনজিওর কর্মীরা। নির্ধারিত সময়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় এনজিও কর্মীরা আমাদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতো।
তিনি আরও বলেন, ‘এসো’ এনজিওর লোকজন আমার মেয়েকে টাকার জন্য চাপ দিতো। তারা মামলা করবে, ধরে নিয়ে যাবে, মামলা করা হয়ে গেছে আপনার নামে- এইসব বলে ভয়ভীতি দেখাতো। এজন্যই আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।
কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের পুরগ্রামে গত ৭ মে শাহারুল ইসলাম (৩৮) নামে এক যুবক ঋণের চাপে আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। তিনি পেশায় দিনমজুর ছিলেন।
কিস্তির টাকা না দিতে পারায় মারধরের অভিযোগও রয়েয়ে এনজিও কর্মীদের বিরুদ্ধে। ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কালাইয়ে রহেদুল ইসলাম, তার স্ত্রী মনিষা বেগম ও মা মোমেনাকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে ‘গাক’ নামে একটি এনজিওর কর্মীদের বিরুদ্ধে।
আহতদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ঋণের কিস্তি নিতে রাত ৮টার দিকে রহেদুলের বাড়িতে যান গাকের উপজেলা ব্যবস্থাপক আব্দুল ওহাব, মাঠকর্মী আনছার আলীসহ চারজন। সেখানে কিস্তির টাকা বকেয়া রাখায় উভয়পক্ষের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে গাক কর্মী আনছার আলীসহ অন্যরা রহেদুলকে মারধর শুরু করেন। এসময় তাকে রক্ষা করতে এসে মা মোমেনা বেগম ও স্ত্রী মনিষা বেগমও মারধরের শিকার হন।
এছাড়া গত তিন বছরে চারটি এনজিওর গ্রাহকের কাছে থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি শহরে গড়ে ওঠা ‘গ্রামীণ সঞ্চয়’ নামে একটি এনজিও ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে গ্রাহকের পাঁচ কোটিরও বেশি টাকা সঞ্চয় নিয়ে উধাও হয়েছে। এর ফলে শতশত গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এছাড়া ২০২১ সালে জয়পুরহাট শহরের সবুজনগর থেকে ‘আদর্শ ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’ নামের একটি এনজিও ৮২০ জন গ্রাহকের কাছ প্রায় ৯ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে।
গ্রাহকের কাছ থেকে ব্ল্যাংক চেক, জমির দলিল নেওয়ার কোনো বৈধতা আছে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসো এনজিওর নির্বাহী পরিচালক মতিনুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, গ্রাহকের কাছ থেকে ব্ল্যাংক চেক নেওয়ার বিষয়টি মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) দেখবে, আপনারা দেখার কেউ নয়।
তার এনজিওর বিরুদ্ধে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা-হামলার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমার এনজিওর কর্মীরা কাউকে মারধর করে না। তবে কোনো গ্রাহক বেশি ঝামেলা করলে টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য আমরা তার বিরুদ্ধে চেকের মামলা করি। সেটিও আমরা আইন অনুযায়ী করে থাকি।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ইমাম হাশেম জাগো নিউজকে বলেন, আমার কাছে জেলার সব এনজিওর তালিকা নেই। আপনার যদি লাগে তাহলে আরটিআই করেন তারপর সংগ্রহ করে দেখা যাবে।
তবে গ্রাহকের কাছ থেকে ব্ল্যাংক চেকের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এমআরএ রয়েছে, তারা দেখবে।
জানতে চাইলে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির লাইসেন্স, রেজুলেশন অ্যান্ড ল’ বিভাগের পরিচালক জিল্লুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, যদি কোনো এনজিও এ ধরনের কাজ করে থাকে আমরা স্পেসিফিক অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেবো।
তিনি বলেন, যদি কোনো গ্রাহক লিখিত অভিযোগ দেন কিংবা আপনাদের প্রতিবেদনের মাধ্যমেও সঠিক তথ্য পেলেও আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।
এমআরআর/জিকেএস