নারী ও শিশু

দারিদ্র্যের ফ্রেমে বন্দি ওদের জীবন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির অদূরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রধান ফটকে শনিবার ভোরে ফটো অ্যালবাম আকৃতির একটি লোহার দণ্ডের উপর বসে ঝিমাচ্ছিল ছয় বছরের ছোট্ট একটি শিশু। দুচোখ তার ঘুমে ঢুলোঢুলো। পরনে হাঁটু পর্যন্ত নামানো টিয়া রঙয়ের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, গোলাপি নীল রঙয়ের বোতাম খোলা ডোরা কাটা শার্ট ও পায়ে লাল রঙয়ের স্পঞ্জের স্যান্ডেল। হাতে কয়েকটি টকটকে লাল গোলাপ। প্রাতঃভ্রমণে যারা বেরিয়েছিলেন তাদের সবার দৃষ্টি ছোট্ট এই ছেলেটির হাতের গোলাপের দিকে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ষোল-সতের বছরের দুটি ছেলে টিপ্পনী কেটে বলে, ‘দেখ- পিচ্চি, এই বয়সে ডেটিং করে’। এ কথা বলে হাসতে হাসতে পার্কের ভেতরে চলে যায় তারা। খানিক পরেই ২৭/২৮ বছরের এক যুবকের চিৎকারে স্পষ্ট হলো শিশুটির পরিচয়। ওই যুবক দূর থেকে খেঁকিয়ে বলে উঠলেন, ‘ওই সুজন, হারামজাদা তোরে সাতসকালে ঘুম থাইক্যা উঠাইয়া দিলাম, ফুল বেঁচতে পাঠাইলাম, আর তুই কিনা এইহানে বইস্যা ঝিমাইতাছস। আইজক্যা তোর নাস্তা বন্ধ’।চিৎকার শুনে ছেলেটি ছুটে গিয়ে এক তরুণ-তরুণী যুগলের সামনে গিয়ে- ‘দুইটা ফুল নেন স্যার, স্যার নেন না, দামে সস্তা, দুইডা ফুল মাত্র ১০ ট্যাহা।’ এ বলে ফুল বিক্রির চেষ্টা চালায়। বার বার অনুরোধ করার পরও তাদের কাছে ফুল বিক্রি করতে ব্যর্থ হয় সে।সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাত-সকালে গোলাপ ফুল বিক্রির জন্য নেমে পড়া ক্ষুদে এ শিশুটির নাম সুজন। পার্কে তার জন্ম, পার্কেই বড় হচ্ছে সে। তার বাবা রিকশাচালক আর মা ফুল বিক্রেতা। পার্কের ভেতর পলিথিনে মোড়ানো ছাপড়া ঘরে বাবা-মা ও একটি ছোট ভাইসহ ছয় সদস্যের পরিবারের বসবাস।এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সুজন জানায়, কিছুক্ষণ আগে তাকে যিনি গালমন্দ করছিলেন তিনি তার বাবা। প্রতিদিন ভোরেই বাবা-মা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেন। মা শাহবাগ থেকে সস্তা দামে গোলাপ ফুল কিনে এনে পানি ছিটিয়ে তরতাজা করে তার হাতে একগুচ্ছ ফুল বিক্রির জন্য তুলে দেন। স্কুলে যায় কিনা জিজ্ঞেস করলে সে না সূচক জবাব দিয়ে জানায়, স্কুলে যাই না, তয় শুক্রবার পার্কের ভেতর পড়ি (স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠন পরিচালিত পাঠশালায়)। সে জানায়, সারাদিন পার্কে ঘুরে ঘুরে তরুণ-তরুণীদের কাছে ফুল বিক্রি করে। গড়ে প্রতিদিন এক-দেড়শ’ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারে। তবে প্রতিদিন একই কাজ করতে তার ভাল লাগে না বলে জানায় সে। অন্যদিকে বিক্রি না করলে খাওয়া বন্ধ থাকে বলেও জানায় সুজন।ঢাকা শহরে বসবাসকারী হাজার হাজার ভাসমান শিশুশ্রমিকদের একজন এই সুজন। দারিদ্র্যের ফ্রেমে বন্দি হয়ে তারা আর দশটা শিশুর মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমইউ/এসএইচএস/আরআইপি