প্রতিদিন হাজারও শ্রমিকের ঘামে চলছে উত্তরের জেলা নীলফামারীর ছোট বড় বিভিন্ন কারখানা। সকাল থেকে সন্ধ্যা, মাঝে মাঝে রাত অবধি এখানকার কল-কারখানাগুলো সচল থাকে বিভিন্ন উৎপাদন নিয়ে। এখানকার উৎপাদিত পণ্য সারাদেশতো বটেই কিছু কিছু যাচ্ছে দেশের বাইরেও। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংসহ ছোট বড় কারখানা মিলে শুধুমাত্র সৈয়দপুরেই গড়ে উঠেছে প্রায় পাঁচশোর বেশি কারখানা। যেসব কারখানায় কর্মরত আছেন প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক। আর তাইতো সৈয়দপুরকে আখ্যায়িত করা হয় শ্রমিকের শহর হিসেবে।
বৃটিশদের হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয়েছিল শ্রমিকের এ শহরের। ১৮৭০ সালে বৃটিশরা একটি লোকসেড চালু করে। পরে ১১০ একর জায়গায় গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে কারখানা। সেখানে কাজ করার জন্য বিহার থেকে আনা হয় শ্রমিক। পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও কাজ করতে আসেন শ্রমিকরা।
রেলওয়ে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা অবসরের পর সৈয়দপুরে গড়ে তোলেন বিভিন্ন ওয়ার্কশপ। সেখানে তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। একটি দুটি করে শুরু করে এখন প্রায় ৫০০ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা গড়ে উঠেছে সৈয়দপুরে। যেখানে কাজ করেন পাঁচ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। এ উপজেলার মূল চালিকাশক্তি এ ওয়ার্কশপগুলোই।
লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে উত্তরের এই ছোট জনপদে। শুধুমাত্র সৈয়দপুরেই তৈরি হচ্ছে প্রেশার কুকার, পাটের ব্যাগ, বস্তা, হ্যান্ডিক্রাফট পণ্য। এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও।
এছাড়াও জেলায় নির্মিত ইপিজেডের তৈরি লেদার ব্যাগ, চশমা, নকল চুল, গাড়ির মডেল সুনাম কুঁড়িয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। এর বাইরেও জেলার ৬ উপজেলায় গড়ে উঠেছে ৬০টির বেশি বিভিন্ন শিল্প কারখানা৷ যেসব কারখানায় কাজ করছেন হাজারো শ্রমিক।
এছাড়া সৈয়দপুরে গড়ে ওঠা ছোট ছোট পোশাক কারখানার ঝুট কাপড়ের তৈরি কিছু কিছু পোশাক চলে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানে। যা দেশের জন্য আনছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। তাই নির্দিষ্ট কোনো মৌসুম নয়, সারাবছরই ব্যস্ত থাকেন এখানকার শ্রমিকরা।
তুলনামূলক সস্তা শ্রম হওয়ায় এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে এত ইন্ডাস্ট্রি। এগুলোর বেশিরভাগই সৈয়দপুরে হলেও গোটা নীলফামারীর অর্থনীতিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শুধু সৈয়দপুর কিংবা নীলফামারী নয়, চাঙ্গা রাখছে দেশের অর্থনীতির একটা অংশকেও। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ হওয়ায় অর্থনৈতিক মুক্তি মিলেছে এ অঞ্চলের মানুষের।
সৈয়দপুরের আমেনা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপের শ্রমিক বিল্লাহ বলেন, আগে আমরা তিন হাজার টাকা বেতন পেতাম। এখন ১০ হাজার পাই। এতে ভালোই সংসার চলে। আমার ভাইও কাজ করছে এখন।
আরেক শ্রমিক ইয়াসিন আলী বলেন, আমাদের আশপাশের সবাই শ্রমিকের কাজ করি। আমাদের বাপ-চাচারাও কাজ করতেন। তাদের থেকেই শিখেছি।
নীলফামারী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সফিকুল ইসলাম ডাবলু বলেন, বলতে পারেন দেশে সৈয়দপুরেই প্রথম শিল্পের ছোঁয়া লেগেছিল। এর মূল কারণ ছিল রেলওয়ে কারখানা। সব মিলিয়ে নীলফামারী জেলা আজ সমৃদ্ধ। ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে৷ আগামীতে এটি একটি প্রসিদ্ধ শিল্পনগরী হবে আশা করি।
বাংলাদেশ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি সৈয়দপুরের সভাপতি এরশাদ হোসেন পাপ্পু বলেন, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংতো আছেই, পাশাপাশি সৈয়দপুরে গড়ে উঠেছে পোশাক কারখানা। যেগুলো ভারত, ভুটানে পণ্য রপ্তানি করছে। বৈদশিক মুদ্রা আসছে। এছাড়াও অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে৷ সব মিলিয়ে সৈয়দপুর একটি অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল রায়হান জাগো নিউজকে বলেন, সৈয়দপুরে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার যেভাবে হচ্ছে তাতে আমি মনে করি এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান এটি। শুধু লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং নয় এখানে বিসিক শিল্পনগরী, ইপিজেড বা অন্যান্য কারখানা মিলে আগামীর সৈয়দপুর বা নীলফামারী একটি আধুনিক ব্যবসায়ীক জনপদ হিসেবে গড়ে উঠবে।
রাজু আহম্মেদ/এফএ/জিকেএস