পাকিস্তানে অপহরণ বেড়েই চলছে। সরকারের সমালোচনা করলেই গুম করা হচ্ছে। দেশটিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও হারিয়ে যাওয়ার পথে। তথ্য বলছে, পুলিশ অনেককেই তুলে নিয়ে গেলেও গ্রেফতার দেখাচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিচার ছাড়াই সাজা ভোগ করছেন অনেকে।
Advertisement
সম্প্রতি পাকিস্তানের জনপ্রিয় জিও নিউজের নির্বাহী প্রযোজক জুবায়ের আনজুমকে করাচির বাসভবন থেকে তুলে নেওয়া হয়। পুলিশের দুটি ভ্যানে তাকে উঠিয়ে দিলেও গ্রেফতার দেখানো হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাকিস্তানে এমন ঘটনা বাড়ছে। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী বা আইনজীবী, সরকারের বিরোধিতা করলেই তাদের বিরুদ্ধে নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় প্রতিশোধ। গ্রেফতর না দেখিয়েও আটকে রাখা তো আছেই, সেইসঙ্গে রয়েছে লাশ গুম করার প্রবণতাও। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা নেই পাকিস্তানের।
পাকিস্তানে হচ্ছে গণতন্ত্রপ্রেমীদের বেঁচে থাকার অধিকার লুণ্ঠন। বিরুদ্ধ মতবাদ বা সরকারের সমালোচনা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না ইসলামাবাদ। আনজুমের ঘটনা উদাহরণ মাত্র। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে দেশটিতে। অনেকেই ভয়ে অপহরণের ঘটনা প্রকাশ্যেও আনছেন না। আনজুমের ঘটনাটি তো প্রকাশ্যেই ঘটেছে। ডেল কলোনি মোড়ের কাছে তার বাড়িতে দুটি পুলিশ ভ্যান আসে এবং তাকে তুলে নিয়ে যায়।
আনজুমের ভাই ওয়াজাহাত জানিয়েছেন, সাদা পোশাকে সরকারি কর্মকর্তারা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও মারধর করে। তারা জুবায়েরের ভাই ওয়াজাহাতকেও ভয় দেখায়। পরে ভাইকে ছেড়ে দিলেও জুবায়েরকে ধরে নিয়ে যায়। জুবায়ের মোবাইলটিও নিয়ে যায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। শুধু তাই নয়, আনজুমের বাড়ির আশেপাশে স্থাপিত ক্লোজ সার্কিট টিভির ফুটেজও নষ্ট করা হয়।
Advertisement
তিনি নিশ্চিত, পাকিস্তানের পুলিশ বা গোয়েন্দারাই তার ভাইকে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ গ্রেফতারের কোনো কারণ জানায়নি। কাগজে কলমে গ্রেফতার দেখানোও হয়নি। এমনকি, পরে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা শুধু তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। গ্রেফতারের বিষয়টি বেমালুম চেপে যান। ওয়াজাহাত জানিয়েছেন, পুলিশ গ্রেফতারের বিষয়ে কোনো কথাই বলেনি।
আনজুমের মতোই জিবরান নাসিরকেও অপহরণ করেছিল পুলিশ। জিবরানের পেছনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণ হলো সে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কড়া সমালোচক। তাছাড়া পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের হয়ে অনেক মামলা লড়েন তিনি। তাই তাকেও অপহরণ করে গ্রেফতার দেখায়নি পুলিশ। জিবরান ও তার স্ত্রী মানশা পাশা গভীর রাতে যখন বাড়ি ফিরছিলেন তখন একটি অভিজাত পাড়ায় দুটি গাড়ি এসে তাদের গাড়ি থামায়। তারপর বন্দুকের নলের সামনে জিবরানকে তুলে নিয়ে যায় সশস্ত্র বাহিনী। জিবরানের মুক্তির দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন।
জিবরানের স্ত্রী পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি জানান, ‘অস্ত্র-শস্ত্রসহ প্রায় ১৫ জন লোক সাধারণ পোশাকে গাড়িতে এসে আমার স্বামীকে তার গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য করে। তাকে মারধর করা হয়। পরে তাকে তাদের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায়।’
জিবরানের অপহরণের প্রতিবাদে শামিল হয় পাকিস্তানের স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন বা এইচআরসিপি। বিবৃতি দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, ‘আমরা দাবি করছি যে জিবরানকে অবিলম্বে নিরাপদে উদ্ধার করা হোক এবং তার অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”
Advertisement
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও বিবৃতি দিয়ে দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছে। যুক্তরাজ্য থেকেও দাবি উঠেছে, জিবরান রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকলে তাকে মুক্তি দিতে হবে। সেইসঙ্গে বেসামরিক আদালতে হাজির করারও পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। জিবরানের অপরাধ, তিনি পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআইয়ের সমর্থক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দলটির সমর্থকদের ওপর ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে মুখ খুলেছেন জিবরান। তাই তার মুখ বন্ধ করতে তাকে পুলিশ দিয়ে অপহরণ করা হয়। পুলিশের পেছনেও পাকিস্তানি সেনার হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। কিন্তু সন্ত্রাসের ভয়ে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলছেন পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ।
জিবরান ফিরে না এলেও বোল টিভির অপহৃত সিনিয়র সাংবাদিক সামি আব্রাহাম অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন। এ বছরের ৩০ মে সকালে তিনি বাসায় ফিরতে সক্ষম হন। সাংবাদিক সামি আব্রাহাম নিজের গাড়িতে রাজধানী ইসলামাবাদের অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে অপহৃত হয়েছিলেন। তাকেও গ্রেফতার দেখানো হয়নি। আসলে গ্রেফতার না দেখিয়ে পুলিশের তুলে নিয়ে যাওয়াটাই পাকিস্তানে দস্তুর হয়ে উঠেছে। গ্রেফতার না দেখিয়েই সাংবাদিকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করে তাদের মুখ বন্ধ করার কৌশল দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে পাকিস্তানে। ইমরান খানের সমর্থক বলে পরিচিত সাংবাদিক ইমরান রিয়াজ খান নিখোঁজ হওয়ার দুই সপ্তাহ পর আব্রাহাম নিখোঁজ হয়েছিলেন।
কেনিয়ায় পাকিস্তানি সাংবাদিক আরশাদ শরীফকে গুলি করে মারার ঘটনা এখনও ভোলেননি পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। অনেকেরই সন্দেহ পাকিস্তানের গোয়েন্দারাই আরশাদকে খুন করেছে। কিন্তু তদন্ত আজও অধরা রয়েছে সেই গুলিকাণ্ডের রহস্য।
তার স্ত্রী জাভেরিয়া সিদ্দিক বলেছেন, আরশাদ শরীফের ওপর গুলি চালানোর প্রমাণ লোপাট করেছে কেনিয়া ও পাকিস্তান সরকার। গত বছরের অক্টোবর মাসে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির উপকণ্ঠে প্রকাশ্য রাস্তায় পুলিশ শরীফকে গুলি করে হত্যা করে। বিবিসির প্রতিবেদনেও এই তথ্য উঠে আসে। ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থার সংবাদদাতা ইমানুয়েল ইগুনজা জানান, জাভেরিয়া সিদ্দিক গত বছর তার স্বামী আরশাদ শরীফের হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন তদন্তের জন্য জাতিসংঘের কাছেও আবেদন করেন।
পাকিস্তানে সাংবাদিক অপহরণ বা খুন অবশ্য নতুন কিছু নয়। পছন্দ না হলেও সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী পাকিস্তান। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক তাহা সিদ্দিকিকেও অপহরণের চেষ্টা করে পাকিস্তান সেনা। সেই পরম্পরা আজও চলছে। সরকারের সমালোচনা করলেই নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষ, কারও ছাড় নেই। স্বাধীন মতামত প্রকাশের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই সেখানে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই গণমাধ্যমেরও কণ্ঠরোধ করতে মরিয়া পুলিশ ও প্রশাসন।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের নিজের নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষার নামে ১৯৭১ সালে দেশের বাঙালি নাগরিকদের বিরুদ্ধে চরম হত্যা নির্যাতনের পথ নিয়েও বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী।
বাংলাদেশের মাটিতে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, তা ছিল বিশ শতাব্দীর অন্যতম নৃশংস গণহত্যা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে ৮ মাস ২ সপ্তাহ ৩ দিনের এই গণহত্যার স্বরূপ ছিল ভয়ঙ্কর। পরিকল্পিত পন্থায় বাঙালিকে খুন করা হয়েছে, গণহারে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে; ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়াসহ অপহরণ, গুম ও বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে এসব বর্বরতায় সহযোগী ছিল বাঙালি ও অবাঙালি সদস্য সমন্বয়ে গঠিত রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটির সদস্যরা।
বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রথম অভিযানটি পরিচালিত হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে। এই অভিযানের মধ্য দিয়ে তারা কেবল নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে উৎখাতের পথই বেছে নেয়নি, একই সঙ্গে বাঙালি সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর এবং ছাত্র-জনতাকে নিধন করার পরিকল্পনা করেছিল। নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এই সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের ফলে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। ফলে ভারতের মাটিতে প্রায় ১ কোটি মানুষের দেশান্তরী হওয়ার মর্মদন্ত অধ্যায়ের সূচনা ঘটে।
৩১ মার্চ লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় লেখা হয়, ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর ঢাকা মহানগরী মুহুর্মুহু তোপধ্বনিতে প্রকম্পিত হতে থাকে। সর্বত্র বোমা বারুদের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। টিক্কা খান বর্বর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে নির্মমভাবে গণবিদ্রোহ দমনে সচেষ্ট হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের প্রধান কার্যালয় পিলখানা সেনা-অভিযানে বিধ্বস্ত হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর সেনাবাহিনী নির্বিচারে ভারী আর আর গান, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ব্যবহার করে।
ইকবাল হলকে তারা প্রধান আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। সেখানে প্রথম ধাক্কাতেই ২০০ ছাত্র নিহত হয়। একদিকে হলগুলোর দিকে উপর্যুপরি শেল নিক্ষেপ করা হতে থাকে অন্যদিকে চলতে থাকে মেশিনগানের গুলি। দুদিন পর্যন্ত পোড়া ঘরগুলোর জানালা-দরজায় মরদেহ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। পথেঘাটে মরদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। জগন্নাথ হলেও বর্বরোচিত আক্রমণ চালানো হয়। কয়েকশ ছাত্র, যারা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী, নিহত-আহত হয়। সৈন্যরা মরদেহগুলোকে গর্ত খুঁড়ে গণকবর দেয়। এরপর ট্যাঙ্ক চালিয়ে মাটি সমান করে। রিপোর্টের একটি অংশ এ রকম: ‘আল্লাহ ও পাকিস্তানের ঐক্যের নামে’ ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত, সন্ত্রস্ত নগরী।’
ইতিহাসের সেই ধারাবাহিকতায় সেনা মদতপুষ্ট পাকিস্তান সরকার প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসছে সাধারণ মানুষের ওপর। বিচার ব্যবস্থাকে অকেজো করে রেখে চলছে সেনা কর্মকর্তা আর রাষ্ট্রব্যবস্থার অকথ্য অত্যাচার। বিচারের বাণী কাঁদছে নীরবে ও নিভৃতে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস