দেশজুড়ে

লোকসান আর ঋণের চাপে মালিক থেকে শ্রমিক ট্রাঙ্ক ব্যবসায়ীরা

ব্রিটিশদের হাত ধরেই শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল উত্তরের জেলা নীলফামারীতে। ১৮৭০ সালে জেলার সৈয়দপুরে ব্রিটিশরা একটি লোকোশেড চালু করে। এরপর সেখানে ১১০ একর যায়গায় গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে কারখানা। আর এই কারখানা ঘিরেই সৈয়দপুরজুড়ে গড়ে ওঠে ছোট ছোট বিভিন্ন কলকারখানা। সেসব কারখানায় তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ট্রাঙ্ক। একসময় গ্রামাঞ্চলে কাপড়-চোপড় থেকে ধরে টাকা-পয়সাও নিরাপদে রাখতে ট্রাঙ্কের ব্যবহার ছিল ব্যাপক।

তবে আধুনিক আসবাবপত্র আসায় এখন আর নেই ট্রাঙ্কের সেই চাহিদা। ব্যবসা মন্দার ফলে অনেকেই ছেড়েছেন এই পেশা। লোকসান আর ঋণের চাপে মালিক থেকে শ্রমিকও হয়েছেন অনেকেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনা মহামারির আগেও সৈয়দপুরে ট্রাঙ্ক তৈরির প্রায় দেড়শ ছোট-বড় কারখানা ছিল। শুরুর দিকে টিন দিয়ে তৈরি হতো ট্রাঙ্ক। পোশাক ও মূল্যবান জিনিস মজুতের একমাত্র আস্থা ছিল এটি। গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতেই ট্রাঙ্ক থাকা যেন ছিল বাধ্যতামূলক। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়েছে ট্রাঙ্কের সেই জৌলুস। পারটেক্সের ড্রয়ার, ওয়ারড্রব ও আলমারির ভিড়ে হারিয়েছে এক সময়ের জনপ্রিয় এই ট্রাঙ্ক।

ফলে দিনদিন লোকসানে পড়েন ট্রাঙ্ক কারখানার মালিকরা। করোনা মহামারির ধাক্কায় একেবারেই থমকে যায় তাদের ব্যবসা। ফলে বন্ধ হয়ে যায় সৈয়দপুরের প্রায় অর্ধশতাধিক কারখানা৷ বর্তমানে ৭০-৮০টি কারখানা সচল থাকলেও নেই কর্মব্যস্ততা।

সৈয়দপুর পৌরসভার গোলাহাট এলাকার বিসমিল্লাহ ট্রাঙ্ক হাউজের মালিক ছিলেন আব্দুল্লাহ ওয়াহেদ। তার কারখানায় কাজ করতেন ১০ শ্রমিক। তবে ব্যবসা মন্দায় ঋণের চাপে বন্ধ হয়ে যায় সেই কারখানা। বর্তমানে তিনিই কাজ করছেন অন্যের কারখানার শ্রমিক হিসেবে।

আব্দুল্লাহ ওয়াহেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের অবস্থা বর্তমানে খুবই খারাপ। আগে তো টিন দিয়ে ট্রাঙ্ক বানাতাম। বর্তমানে তো শিট দিয়ে বানাতে হয়। কিন্তু এগুলা তো আমাদের বাংলাদেশের জিনিস না, বাইরে থেকে ডলার দিয়ে কিনে আনতে হয়। এখন বিভিন্ন জিনিস বের হইছে পারটেক্স, প্লাস্টিক। মানুষ সেগুলোই কেনে। এখন ট্রাংক কেউ কেনে না।

তিনি আরও বলেন, আমার নিজস্ব কারখানা ছিল। আমি সরকারকে ইনকাম ট্যাক্স দিতাম। আমার লাইসেন্স আছে। ব্যবসার এমন অবস্থা আমি মহাজনি ছেড়ে লেবারের কাজ করছি। এখন ওই লাইসেন্সও আমার গলার কাঁটা। প্রতিমাসে ট্যাক্স দেওয়া লাগে।

নিহাত ট্রাঙ্ক কারখানার স্বত্বাধিকারী নাদিম আহমেদ বলেন, ব্যবসার অবস্থা ভালো না। দিনেদিনে শিটের দাম বেড়ে যাচ্ছে৷ সেদিক বিবেচনায় দাম বাড়ছে। কিন্তু দাম বাড়লে তো মানুষ কিনবে না। ঋণ নিয়ে কাজ করতেছি। দেখেন সব ট্রাঙ্ক জমা হয়ে আছে। এভাবে ঋণ নিয়ে আর কত চলব? এখন ব্যবসা বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

শাহরিয়ার আকন্দ নামে এক শ্রমিক বলেন, আগে আমরা দিনে তিনটা ট্রাঙ্ক তৈরি করতাম। এখন একটা বানাই, মাঝেমাঝে তো কাজই থাকে না। কম কাজ করে তো মজুরিতে পোষায় না। অন্য কাজ করা ছাড়া আর উপায় নেই।

জলঢাকা উপজেলার ট্রাঙ্ক বিক্রেতা বুলবুল ইসলাম বুলু বলেন, তিন মাস আগে ১০টা ট্রাঙ্ক এনে রাখছি। এখনো সাতটা আছে। মানুষ কিনতে চায় না৷ এখন অনেক সুন্দর আধুনিক জিনিস বের হইছে। এজন্য আমরা ট্রাঙ্ক আনি না।

এ বিষয়ে কথা হলে সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রায়হান ফয়সাল জাগো নিউজকে বলেন, এরইমধ্যেই হস্তশিল্পের উন্নতির লক্ষে আমরা কাজ শুরু করেছি। ট্রাঙ্ক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা প্রয়োজন হলে আমরা তাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করবো।

রাজু আহম্মেদ/এমআরআর/জিকেএস