ক্যাম্পাস

তথ্য জালিয়াতি করে ‘শিক্ষক হচ্ছেন’ চবির সহকারী প্রক্টরের স্ত্রী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পালি বিভাগের শিক্ষক হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন অভি বড়ুয়া। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রী। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে অন্য প্রার্থীদের তুলনায় অভির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত প্রায় সব যোগ্যতাই কম। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে রয়েছে আবেদনপত্রে তথ্য জালিয়াতি, আবেদনের শর্ত পূরণ না করা এবং পরিকল্পনা কমিটির সুপারিশ না থাকার মতো মারাত্মক অভিযোগ। এছাড়া রয়েছে বিভাগীয় সভাপতির নোট অব ডিসেন্টও (দ্বিমত)। কিন্তু এতকিছুর পরও স্বামী সহকারী প্রক্টর হওয়ার সুযোগ নিয়ে উপাচার্যের সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন অভি বড়ুয়া। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার (১৪ জুলাই) অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ৫৪৪তম সিন্ডিকেট সভায় এ নিয়োগ চূড়ান্ত হতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৫ জানুয়ারি ও ২৪ আগস্ট পালি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপকের বিপরীতে যথাক্রমে একজন স্থায়ী প্রভাষক ও একজন অস্থায়ী প্রভাষকের জন্য পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। স্থায়ী প্রভাষকের জন্য ৩৮ প্রার্থী এবং অস্থায়ী প্রভাষকের জন্য ২৭ জন প্রার্থী আবেদন করেন। বিজ্ঞাপন অনুযায়ী দুজনকে নিয়োগের কথা থাকলেও চারজনের নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করে নিয়োগ বোর্ড। সে সুপারিশে চার প্রার্থীর মধ্যে অভি বড়ুয়াকে সবার প্রথমে রাখা হয়।

আরও পড়ুন: ফেসবুকে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে সেই কর্মকর্তার ছেলের রেজাল্ট হুবহু মিল 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভি বড়ুয়াকে নিয়োগ দিতেই বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত পদসংখ্যার অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের অতিরিক্ত নিয়োগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ইউজিসির নির্দেশনার পরিপন্থি বলেও মনে করছেন তারা।

বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর গত বছরের ৩ মার্চ অভি বড়ুয়া তার আবেদনপত্রে স্নাতকোত্তর (এমএ) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন মর্মে অসত্য তথ্য দেন। তখন বিষয়টি নজরে না আসায় তার আবেদনের সুপারিশ করা হয়। পরে আরেকটি অস্থায়ী পদের নিয়োগ বিজ্ঞাপ্তিতে পালি বিভাগের বর্তমান সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া রুপন গত ৬ নভেম্বর পরিকল্পনা কমিটির সভা আহ্বান করেন। সভায় ২৭টি আবেদন যাচাই-বাছাই করে ২১টি গৃহীত হয়। অভি বড়ুয়ার আবেদনপত্র তথা ফলাফল সংক্রান্ত তথ্য অসত্য প্রমাণিত হওয়ায় বিভাগ থেকে তার নিয়োগের সুপারিশ না করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অভির স্বামী অরূপ বড়ুয়া পরিকল্পনা কমিটির গোপন সিদ্ধান্ত জেনে যান। এরপর তিনি স্ত্রীকে দিয়ে সংশোধনী আবেদন করান। তবে বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির সভায় সেই আবেদনও সুপারিশ করা হয়নি।

বিভাগীয় সূত্রে জানা যায়, অভি বড়ুয়ার স্নাতকের ফলাফলে অবস্থান ২৬তম এবং স্নাতকোত্তরে ১৩তম। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০ দশমিক ২ শতাংশ নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি। স্নাতক পরীক্ষায় ৩ দশমিক ৪৩ পয়েন্ট পেয়েছিলেন। স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পর গত ২০ বছরেও কোথাও চাকরির অভিজ্ঞতা নেই তার। যেখানে যাচাই-বাছাই বিশ্লেষণে দেখা যায়, অন্য ৩৮ জন আবেদনকারীর অধিকাংশই প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফলে অভি বড়ুয়ার চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। তাদের অনেকের আবার শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে।

আরও পড়ুন: ৪০ নম্বরও পাননি ডি ইউনিটের ২৬ হাজার পরীক্ষার্থী 

এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ নিয়োগে নানা অসঙ্গতি ও বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগের বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা দ্বিমত পোষণ করেন বোর্ডের সদস্য ও পালি বিভাগের সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া রুপন। কিন্তু এরপরও সহকারী প্রক্টরের স্ত্রী হওয়ার কারণে প্রভাব খাটিয়ে উপাচার্যের উপস্থিতিতে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা চারপ্রার্থীর মধ্যে অভি বড়ুয়াকে তালিকার এক নম্বরে রাখা হয়।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, বিভাগ সূত্রে আমরা জেনেছি পরিকল্পনা কমিটি ওই প্রার্থীর (অভির) ব্যাপারে সুপারিশ করেননি। তাছাড়া তিনি তথ্য জালিয়াতি করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মবহির্ভূত। আমরা উপাচার্যকেও সঠিক নিয়ম মেনে শিক্ষক নিয়োগের জন্য অবহিত করেছি। তারপরও অনিয়ম করে কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে শিক্ষক সমিতি প্রতিবাদ করবে।

পালি বিভাগের সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া বলেন, অভি বড়ুয়ার স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফল অন্য প্রার্থীদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ। এছাড়া বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটি সুপারিশ না করায় এবং নির্বাচনী বোর্ডে অসন্তোষজনক পারফর্ম করায় প্রভাষক পদে তাকে সুপারিশের ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে বলেন, আমি ওই নিয়োগ বোর্ডের সদস্য নই। তাই এ ব্যাপারে জানি না। অনিয়ম থাকলে নিয়োগ বোর্ড দেখবে।

আরও পড়ুন: প্রধান সমন্বয়কের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ 

এদিকে নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ এনে গত ৮ এপ্রিল চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ও রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমেদকে প্রার্থী সজীব সিংহ ও বোধি মিত্র শ্রামনের পক্ষে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্ট ও চট্টগ্রাম জজকোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ রাসেল।

এ আইনজীবী জাগো নিউজকে বলেন, এখানে নিয়োগের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। আমরা জানতে পেরেছি, অনিয়ম করে অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য প্রার্থীরা লিগ্যাল নোটিশের মাধ্যমে উল্লিখিত নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে যোগ্য প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে বিনীত আবেদন জানিয়েছেন। যদি তা গ্রাহ্য করা না হয় তাহলে আমরা নিয়োগ বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করবো।

লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো চাকরিপ্রত্যার্শী বোধি মিত্র শ্রামন জাগো নিউজকে জানান, যে প্রার্থীকে সুপারিশে নিয়োগের চেষ্টা চলছে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা অন্য প্রার্থীদের চেয়ে কম। স্নাতক শেষে তার শিক্ষকতার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ভাইভা বোর্ডে কোনো প্রশ্নের উত্তরও তিনি দিতে পারেননি।

আরও পড়ুন: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খাবারের দাম-রিকশা ভাড়ায় নৈরাজ্য 

তিনি বলেন, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে তার (অভি বড়ুয়া) থেকে আমাদের ফলাফল ভালো। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতার সঙ্গে আছি। তাহলে কেন যোগ্যদের বাদ দিয়ে একজন গৃহিণীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে? যদি এ নিয়োগ বাতিল না করা হয় আমরা আইনজীবীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতে যাবো।

এ বিষয়ে জানতে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে বেশ কয়েকবার ফোনকল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একইভাবে সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়াকে বারবার ফোনকল করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।

আহমেদ জুনাইদ/এমকেআর/জিকেএস