মুক্তিযোদ্ধা ময়েন উদ্দিন। একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ১৯৫২ সালে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার জন্তিগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চার নম্বর। ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৭৫ সালে বিএসসি পাস করেন। বর্তমানের নওগাঁ শহরের উকিল পাড়ায় পরিবারসহ বসবাস করেন।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ও অনুপ্রেরণায় তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। কোনোভাবেই বাঙালির উপর নির্যাতন চালাতে দেয়া হবে না। এজন্য তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন যুদ্ধাস্ত্র। বাবা-মার শত নিষেধ শর্তেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন যুদ্ধে। ময়েন উদ্দিনের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। তিন মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং ছেলে ভূমি অফিসে চাকরি করেন। তিনি ২০০৫ সালে গেজেটভুক্ত হন।মুক্তিযোদ্ধা ময়েন উদ্দিন জানান, ১৯৭১ সালে ১৬ মে ভারতের মধুপুর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের জন্য যান। ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জিল্লুর রহমান ও আব্দুর রাজ্জাকের কাছে তিনিসহ অনেকেই ১৩ দিনের প্রশিক্ষণ নেন। এরপর দেশে চলে আসেন। মহাদেবপুর উপজেলা থেকে পত্নীতলা নজিপুর রোডে রাত ২টার দিকে ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধার পাকিস্তান ও পাঞ্জাবের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকসেনারা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। তবে অতুল চন্দ্র বিশ্বাস নামে এক সহযোগীর মাজার নিচের অংশে গুলি লাগে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর তাকে ঘাড়ে করে আমরা কয়েকজন মিলে আবার ভারতের উদ্যেশে রওনা দিলাম। পাটী আমলা সীমান্ত দিয়ে ভারতের কাছে পৌঁছালাম। ভারতের কাছে ঘোষনগর গ্রামে মোকলেছুর রহমান নামের এক ব্যক্তির বাড়ির দোতলায় কয়েকজন মিলে আশ্রয় নেয়া হয়। সেখানে দিনের বেলায় পাঞ্জাবের লোকজন ঘোরাঘুরি করতো এবং মুক্তিবাহিনীদের সন্ধান করতো। কোন লোকজনের সঙ্গে পাঞ্জাবের দেখা হলে তারা বলতো `তোমরা মুক্তি ফোর্স দেখা হ্যায়`। আমরা দোতলার উপর থেকে তা দেখতাম। সন্ধ্যার পর রাতের খাবার খেয়ে ভারতে প্রবেশ করলাম। অতুল চন্দ্র বিশ্বাসকে সেভেন সেক্টরে জমা দিলাম চিকিৎসার জন্য। এরপর সেখানে বাংঙ্কার ডিউটি করলাম ৭ দিন। প্রত্যেক ২ ঘণ্টা করে পালা করে ডিউটি করতাম। যুদ্ধে অংশগ্রহণের আরেকটি ঘটনায় ময়েন উদ্দিন জানান, নওগাঁ সদরের মল্লিকপুর গ্রামে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছিলাম। এ খরবটা বিহারিরা গোপনে পাঞ্জাবদের জানিয়ে দেয়। মল্লিকপুর গ্রামের পূর্বদিকে খাড়ির (খাল) উপর একটা ব্রিজ ছিল। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের ২৩ তারিখ (সম্ভবত) দুপুর ২টার দিকে কমান্ডার মোজাফফর হোসেন ব্রিজের নিচে জাম্পিং মাইন সেটিং করে দিলেন। আমরা যে যার মতো যুদ্ধের জন্য প্রস্তত হলাম। আমরা আগেই মারমা, মল্লিকপুর গ্রামের সবাইকে পশ্চিম দিক দিকে চলে যেতে বলেছিলাম। অর্থাৎ গ্রামটা ফাঁকা করার জন্য। গ্রামের পূর্ব দিক থেকে পাঞ্জাবরা ৩টি ট্রাক নিয়ে আমাদের দিকে আসছে। দূরত্ব প্রায় দেড়শ ফিট। ব্রিজের কাছাকাছি। কি মনে করে তারা আর ব্রিজে না উঠে পেছনের দিক অর্থ্যাৎ নওগাঁর দিকে চলে গেলেন। তারপর আমরা যে যার মতো উঠে গেলাম। এরপর গ্রামের লোক আবার গ্রামে ফিরে এলো।ময়েন উদ্দিন বলেন, মনে হয় আবার একবার যুদ্ধ করতে হবে। রাজাকারদের যতদিন না ফাঁসি হচ্ছে ততদিন মনে শান্তি নেই। যখন কারো উপর অন্যায়, অত্যাচার দেখি তখন ঠিক থাকতে পারি না। মনের মধ্যে কেমন একটা কাজ করে। একাত্তরে আমার বড় ভাইকে পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করেছে।আব্বাস আলী/এসএস/পিআর