মাছের প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনে প্রবেশের সব ধরনের পাস পারমিট বন্ধ রাখা হয়। একইসঙ্গে তিন মাসের জন্য সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কোনো তোয়াক্কা না করেই দেদারসে চলছে মাছ শিকার।
নিষেধাজ্ঞার সময়ে সুন্দরবনের খাল ও নদী থেকে মাছ-কাঁকড়া শিকারের অভিযোগে গত ২ মাসে আটক করা হয়েছে ১০১ জনকে। একই সময়ে আটটি ইঞ্জিন চালিত ট্রলার, ১৩০টি নৌকা এবং কাঁকড়া পরিবহনকালে একটি পিকআপভ্যান জব্দ করা হয়েছে।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের, রেঞ্জ কর্মকর্তা, সহকারী বন সংরক্ষক ইকবাল হোছাইন চৌধুরী জাগো নিউজকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিনমাস পুরো সুন্দরবনে সব পাশ পারমিট বন্ধ থাকায় কোনো পর্যটক, জেলে বা নৌযান সুন্দরবনে প্রবেশের সুযোগ নেই। তবে গত দুই মাসে (জুন, জুলাই) সাতক্ষীরা রেঞ্জে সাতটি পিওআর মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় ২২ জনকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ৩১টি ইউডিওআর মামলা এবং ১৬টি সিওআর মামলা (যার আসামি সংখ্যা ৭৯ জন) করা হয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে তেইশ লাখ ছত্রিশ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে অপহৃত ১৪ জেলে উদ্ধার, ৫ বন-দস্যু গ্রেফতার
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি অভয়ারণ্য এলাকায় নিয়মিত টহল জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া স্মার্ট টিমের অভিযান চলছে। কোনো এলাকা থেকে খবর পেলে আমি নিজেও অভিযান করছি। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুন্দরবনে প্রবেশের নিয়মিত পাশ দেওয়া হবে। তখন পর্যটক ও বনজীবীরা বনে প্রবেশ করতে পারবেন। কিন্তু অভায়রণ্য এলাকায় সব সময় প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন দোবেকী, পুষ্পকাটি, নোটাবেকী, মান্দারবাড়ীয়া ও হলদেবুনিয়া বন টহল ফাঁড়ির অধিকাংশ এলাকাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও মাছের প্রজননের জন্য অভয়ারণ্য এলাকার খালে বনজীবীদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
স্থানীয়দের অভিযোগ কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা ও স্থানীয় কয়েকজন দালালের মাধ্যমে অভায়রণ্য এলাকায় এসব অপকর্ম চলছে। অভয়ারণ্য এলাকা থেকে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের ফলে নষ্ট হচ্ছে সুন্দরবনের মাছের প্রজননক্ষেত্র। হুমকিতে পড়েছে পুরো সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে সাত জেলেকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা
তবে বন বিভাগের কর্মকর্তারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় আগের চেয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। স্থানীয় ফরেস্ট ক্যাম্প ছাড়াও স্মার্ট টিম গঠন করে টহল করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মাছ ধরার দায়ে বেশ কয়েকজন জেলেকে আটক করা হয়েছে।
সম্প্রতি বন বিভাগের হাতে আটক হওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জেলে জাগো নিউজকে বলেন, অভয়ারণ্য এলাকার খালগুলোতে অল্প সময়ে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। বিষ দিলে আরও বেশি মাছ পাওয়া যায়। এজন্য স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও দালালের মাধ্যমে টহল ফাঁড়ি ও স্মার্ট টিমের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে অভয়ারণ্যে এলাকায় মাছ ধরেন তারা। কিন্তু দালাল যদি টাকা দিতে দেরি করে বা না দেয় তখন অভিযান করে তাদের আটক করা হয়। তারা টাকা পেলে কোনো সমস্যা নেই। বিষ দিয়ে মাছ শিকারের বিষয়টিও স্বীকার করেন তারা।
সাতক্ষীরা সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক গাজী সালাউদ্দিন বাপ্পি জাগো নিউজকে বলেন, নিষিদ্ধ সময়েও উপকূল থেকে প্রতিদিনই অনেক অসাধু জেলেরা অভায়রণ্য এলাকায় প্রবেশ করে মাছ ও কাঁকড়া শিকার করছে। এদের বড় একটি অংশ আবার খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে। এদের সঙ্গে চোরাশিকারিরা বনে প্রবেশ করে হরিণ ও বাঘ শিকারের কাজও করে থাকে। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠেছে দালাল সিন্ডিকেট। এরাই মূলত তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।
আরও পড়ুন: জোয়ারের পানিতে প্লাবিত গোটা সুন্দরবন
তিনি আরও বলেন, বন বিভাগের সব কর্মকর্তা অসাধু নয় বলেই নিয়মিত এরা আটক হচ্ছে। মালামাল জব্দ ও মামলা হচ্ছে। তারপরও এসব কাজ থেমে নেই। এর প্রধান কারণ উপকূলের দালাল চক্র। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এটি বন্ধ হবে না।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের (ডিএফও) ড. আবু নাসের মোহসীন হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ সময় বিভিন্ন স্টেশন ও টহল ফাঁড়ির সদস্যরা প্রতিনিয়ত টহল কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এরই মধ্যে বন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অনেককে আটক করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতায় এক লাখ ১৯ হাজার ৭১৮ হেক্টর এলাকা অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। আর প্রতি বছর ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের নদীতে মাছের প্রজনন মৌসুম চলে। বন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এই তিন মাস সুন্দরবনে সব ধরনের পাশ পারমিট বন্ধ রাখা হয়েছে।
আহসানুর রহমান রাজীব/জেএস/জেআইএম