ফিচার

পাহাড়পুরে মানুষ-শেয়ালের বন্ধুত্ব

ইতিহাস-ঐতিহ্যে ঘেরা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর মহাবিহার। যা বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের অনন্য নিদর্শনও বটে। শুধু যে দেশের ঐতিহ্য তা নয় বিশ্বের ইতিহাসেও জায়গা করে নিয়েছে এই স্থান।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নে অবস্থিত। বিশেষ দিনগুলোতে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়।

আরও পড়ুন: যে দেশে বিদায়বেলায় ‘টাটা’ বললেই হতে পারে জেল 

কোনো এক ছুটির দিনে সেখানে ঘুরতে গিয়েছিল নওগাঁর একটি পরিবার। তাদের মতো অনেকেই পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘুরতে আসেন এই ঐতিহাসিক পাহাড়পুর। শুধু বাঙালি নন, বিদেশের শত শত ভ্রমণপিপাসু মানুষের দেখা মেলে সেখানে।

মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা মিলবে জাদুঘরের। সেখানে মহাস্থানগড়ের অসংখ্য প্রত্নবস্তুর নমুনা আছে। বিভিন্ন রাজবংশের শাসনামলের অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন এখানে যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত আছে।

এছাড়া পাহাড়পুর সংলগ্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু মূর্তি। লাল পাথরের দণ্ডায়মান শীতলা মূর্তি, বেলে পাথরের চামুন্ডা মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের দণ্ডায়মান গণেশ।

আরও পড়ুন: যে ৫ দেশে পৌঁছাতে পারে না প্লেন 

আরও আছে কৃষ্ণ পাথরের বিষ্ণুর খণ্ডাংশ, দুবলহাটির মহারানির তৈলচিত্র, কৃষ্ণপাথরের লক্ষ্মী, কৃষ্ণপাথরের উমা মূর্তি, বেলে পাথরের গৌরী মূর্তি, বেলে পাথরের বিষ্ণু মূর্তি, সূর্য মূর্তি, নন্দী মূর্তি, কৃষ্ণ পাথরের বিষ্ণু মূর্তি ইত্যাদি।

জাদুঘর থেকে মন্দিরে যেতে খানিকটা হেঁটে স্থাপনা এলাকায় পৌঁছাতেই চোখ নয়নাভিরাম দৃশ্যের দেখা মিলবে। রোদের আলোয় স্থাপনার সোনালি ইটগুলো স্বর্ণের মতো ঝলমল করে ওঠে।

এছাড়া প্রবেশপথ থেকে মূল মন্দিরে যেতে পথের দুধারে পরম যত্নে বেড়ে উঠা ফুলের বাগান যা পাহাড়পুরের সৌন্দর্য শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। মন্দিরের দেয়ালে অসংখ্য প্রাণীর ছবি আঁকা। প্রাচীন মিসরীয় ভাষা হায়ারোগ্লিফের মতো।

আরও পড়ুন: সোনার চেয়েও যে কারণে দামি হাতির দাঁত 

এখানের বিশাল এলাকাজুড়ে পুরোনো দিনের ছোট ছোট ইট দিয়ে নির্মিত প্রশস্ত দেয়াল। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল।

চীন, তিব্বত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন।

পাহাড়পুরে সীমানা দেয়াল বরাবর অভ্যন্তরে সারিবদ্ধ ছোট ছোট কক্ষ আছে। উত্তর দিকের বাহুতে ৪৫টি ও অন্য তিন দিকে মোট ৪৪টি করে কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে দরজা আছে। এই দরজাগুলো ভেতরের দিকে প্রশস্ত হলেও বাইরের দিকে সরু।

আরও পড়ুন: একপাশে মেঘালয়ের পাহাড়, অন্যপাশে শাপলার রাজ্য 

এছাড়া বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে প্রাচীরের বাইরে শানবাঁধানো ঘাট আছে। এটাকে সন্ধ্যাবতীর ঘাট বলা হয়। জানা যায় রাজা মৈদলনের কন্যা সন্ধ্যাবতী এ ঘাটে নিয়মিত স্নান করতেন।

আরও দেখা যায় মানুষে পশুতে বন্ধুত্ব। বুনো শেয়ালের সঙ্গে মানুষের এমন বন্ধুত্বের নজির বোধ হয় আর কোথাও নেই! নওগাঁতে বিপন্ন প্রজাতির খেঁকশিয়ালের সঙ্গে মানুষের সখ্যতা গড়ে উঠেছে করোনাকাল থেকে।

এমনটা সম্ভব করেছেন নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের দেখাদেখি গ্রামবাসীও এখন শেয়ালগুলোকে ভালবাসতে শুরু করেছেন। মাঝে মধ্যে এলাকাবাসীরাও নিয়ে আসছেন খাবার।

আরও পড়ুন: চারপাশে শুধুই পানি, একটি বাড়িই দ্বীপের সঙ্গী 

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। রাজা ধর্মপাল দেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।

১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন। ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়। নওগাঁ ইতিহাস-ঐতিহ্যে ঘেরা জেলা। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বাদেও পুরো জেলাজুড়ে বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে।

তবে কেউ যদি রাজধানী থেকে এই প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন দেখতে আসতে চান তাহলে প্রথমে নওগাঁ জেলা শহরে আসতে হবে। তারপর নওগাঁ বালুডাঙ্গা বাস টার্মিনাল হতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বাস ভাড়ায় পৌঁছে যাবেন পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে।

লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী

জেএমএস/জিকেএস