রাজধানীর মতিঝিল, রমনা, শাহবাগ ও পল্টন থানা এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন। এই সংসদীয় আসনটিকে ঢাকার রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। একসময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মাধ্যমে আসনটির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতো। তবে এবারের সংসদ নির্বাচনে সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তেমন জৌলুসের আভাস মিলছে না।
২০০৮ সাল থেকে টানা ১৫ বছর এই এলাকার সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে টানা তিনবার নির্বাচন করে জয় পান চৌকস এ রাজনীতিক।
আরও পড়ুন: ঢাকা-৮ আসনে অভিভাবক খুঁজছে আওয়ামী লীগ
এবার আসনটি মহাজোটের শরিক প্রার্থীকে ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ। মেনন জোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকার মনোনয়ন নিয়েছেন বরিশাল-২ আসন থেকে। ঢাকা-৮ আসনের নির্বাচনী লড়াইয়ে এবার রাশেদ খান মেনন যেমন নেই, নেই বিএনপিও। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে এবার এ আসন থেকে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীকে ভোটে লড়ছেন আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
মেনন জোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকার মনোনয়ন নিয়েছেন বরিশাল-২ আসন থেকে। ঢাকা-৮ আসনের নির্বাচনী লড়াইয়ে এবার রাশেদ খান মেনন যেমন নেই, নেই বিএনপিও। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে এবার এই আসন থেকে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীকে ভোটে লড়ছেন আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম
নৌকার হেভিওয়েট এই প্রার্থীর সঙ্গে আলোচিত এ আসনে নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন আরও ১০ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী এম এ ইউসুফ সোনালী আঁশ প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। ভোটের লড়াইয়ে আছেন সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের ছড়ি প্রতীকের প্রার্থী রাসেল কবির। ফুলের মালা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন তরিকত ফেডারেশনের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান।
এছাড়া ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ থেকে টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে আছেন সাইফুল ইসলাম, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি থেকে আম প্রতীক নিয়ে আবুল কালাম জুয়েল, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি থেকে একতারা প্রতীক নিয়ে খন্দকার এনামুল নাছির, জাতীয় পার্টি থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জুবের আলম খান, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট থেকে মোমবাতি প্রতীক নিয়ে এস এম সরওয়ার, ইসলামী ঐক্যজোট থেকে মিনার প্রতীক নিয়ে আবু নোমান মোহাম্মদ জিয়াউল হক মজুমদার এবং গণতন্ত্রী পার্টি থেকে কবুতর প্রতীক নিয়ে লড়ছেন শাহাদাত হোসেন।
ঢাকা-৮ আসনের নির্বাচনে সব দিক থেকেই এগিয়ে থাকছেন নৌকার প্রার্থী বাহাউদ্দিন নাছিম। তার সঙ্গে লড়তে ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ভোটের মাঠে নামলেও নাছিমকে মূল চ্যালেঞ্জটা কে জানাবেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এলাকার বাসিন্দা ও ভোটাররা মনে করছেন, ১০ প্রার্থীর কেউই নৌকার প্রার্থীকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন না। বাহাউদ্দিন নাছিম বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয় পাবেন। অন্যদিকে একাধিক প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্তও হতে পারে।
আরও পড়ুন: হলে ঢাকা-৮ আসনকে স্মার্ট এলাকা করবো: নাছিম
গত কয়েকদিন এই সংসদীয় আসনের ভোটার অথবা বাসিন্দা এমন অন্তত দুইশ জনের সঙ্গে কথা বলে এ ধরনের অভিমত পাওয়া গেছে। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই বলেছেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী যে ভোট পাবেন, কোনো প্রার্থীই তার ধারে কাছে থাকতে পারবেন না। এমনকি বাকি ১০ জন মিলেও নাছিমের সমান ভোট পাবেন না। তবে নৌকার প্রার্থীর মূল চ্যালেঞ্জটা হবে কেন্দ্রে ভোটার টানা।
স্থানীয়রা বলছেন, ঢাকা-৮ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের ব্যবধান খুব বেশি নয়। এবারের নির্বাচনে যেহেতু বিএনপি অংশ নেয়নি, তাই বিএনপির সমর্থকেরা খুব একটা ভোট দিতে যাবেন না। সেক্ষেত্রে সেখানে কত শতাংশ ভোট পড়ে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
দীর্ঘদিন ধরে ওই সংসদীয় এলাকায় বাস করেন মো. শরিফুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমি এখানকার পাঁচটি নির্বাচন দেখেছি। গত তিনটি নির্বাচন বাদ দিলে এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের ব্যবধান খুব কম। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মাধ্যমে এখান থেকে আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেন। এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে অন্য কোনো দলের তেমন ভোট নেই। এবার যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে নেই, তাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী খুব সহজেই জয় পেতে পারেন।
এগিয়ে থাকছেন নৌকার প্রার্থী বাহাউদ্দিন নাছিম। তার সঙ্গে লড়তে ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ভোটের মাঠে নামলেও নাছিমকে মূল চ্যালেঞ্জটা কে জানাবেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এলাকার বাসিন্দা ও ভোটাররা মনে করছেন, ১০ প্রার্থীর কেউই নৌকার প্রার্থীকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন না
শান্তিনগরের বাসিন্দা জুয়েল হাসান বলেন, এবারের নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে কোনো প্রার্থী তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারবেন না। এখান থেকে নৌকার প্রার্থী বিপুল ভোটে জয় পাবেন। বাকি প্রার্থীরা হাতেগোনা কিছু ভোট পেতে পারেন। একাধিক প্রার্থীর জামানত রক্ষাও কঠিন হতে পারে। তবে কেন্দ্রে ভোটার নিয়ে আসতে পারাটাই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
প্রায় একই ধরনের কথা বলেন শাহজাহানপুরের আলেয়া বেগম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে নৌকার প্রার্থীকে কেউ চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে না। নৌকার প্রার্থীর মূল চ্যালেঞ্জ হবে ভোটার টানা। ভোটারদের কত শতাংশ ভোট দিতে কেন্দ্রে যান সেটাই দেখার বিষয়। যে ভোট পড়বে তার ৯০ শতাংশ নৌকার প্রার্থী পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ঢাকা-৮ আসনের আগের সংসদ সদস্যরাবর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৯, ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা-৮ আসনটি গঠিত। স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা-৮ আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কে এম শামসুল হুদা। ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের এই প্রার্থী।
আরও পড়ুন: ঢাকা ছেড়ে নৌকায় চড়ে বরিশালে মেনন
১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী মো. আব্দুল হাই। এরপর ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১২ বছর পর ১৯৯১ সালে আবারও ঢাকা-৮ আসনের দখল ফিরে পায় বিএনপি। ওই নির্বাচনে আসনটি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মীর শওকত আলী। আর ২৩ বছর পর ১৯৯৬ সালে আসনটির দখল ফিরে পায় আওয়ামী লীগ। নৌকা প্রতীক নিয়ে আসনটি থেকে নির্বাচিত হন পুরান ঢাকার জনপ্রিয় নেতা হাজী মোহাম্মদ সেলিম। পাঁচ বছর পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে আনসটি পুনরুদ্ধার করেন বিএনপির নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু।
এবারের নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে কোনো প্রার্থী তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারবেন না। এখান থেকে নৌকার প্রার্থী বিপুল ভোটে জয় পাবেন। বাকি প্রার্থীরা হাতেগোনা কিছু ভোট পেতে পারেন। একাধিক প্রার্থীর জামানত রক্ষাও কঠিন হতে পারে। তবে কেন্দ্রে ভোটার নিয়ে আসতে পারাটাই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে
এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠন করে ঢাকা-৮ আসন থেকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটের লড়াইয়ে নামেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং প্রায় ৩৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালেও মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা নিয়ে এ আসন থেকে জয় পান মেনন। এর মাধ্যমে টানা ১৫ বছর ওই আসনে সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ঢাকা-৮ আসনে অতীতে ভোটের লড়াই কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মীর শওকত আলী ৫৩ হাজার ৬৫১ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন ভোট পান ৩৪ হাজার ২৮৫ ভোট। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সাব্বির আহমেদ ২ হাজার ৩১৮ ভোট, বিকেএ’র প্রার্থী আহমদুল্লাহ আশরাফ ১ হাজার ৪৪৭ ভোট এবং জাতীয় পার্টির গুলজার হোসেন ১ হাজার ৩৯৮ ভোট পান। অন্য প্রার্থীরা কেউ ভোটের সংখ্যায় হাজারের ঘরে পৌঁছাতে পারেননি।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাজী মোহাম্মদ সেলিম ৭৭ হাজার ৬৪২ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। বিএনপি প্রার্থী আবুল হাসনাত পান ৫৮ হাজার ৩৬৭ ভোট। এছাড়া জাতীয় পার্টির সাইফুদ্দিন আহমেদ ১৪ হাজার ২২ ভোট, জামায়াতের সাব্বির আহমেদ ৩ হাজার ৪৮৬ ভোট এবং ইসলামী ঐক্য জোটের জামাল নাসের চৌধুরী ১ হাজার ৮৭৮ ভোট পান। আর কোনো প্রার্থী এক হাজার ভোট পাননি।
আরও পড়ুন: কেন্দ্রে যেতে ভোটাররা উন্মুখ হয়ে আছে
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ৮৯ হাজার ৭৮৯ ভোট পেয়ে জয় পায়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাজী মোহাম্মদ সেলিম ভোট পান ৮৮ হাজার ৬৯৭ ভোট। অর্থাৎ মাত্র ১ হাজার ৯২ ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। অন্য প্রার্থীদের মধ্যে ইসলামী জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের সাইফুদ্দিন আহমেদ ৫ হাজার ৪০৩ ভোট এবং বিকেএ’র প্রার্থী কারী শাহ আহমাদুল্লাহ ১ হাজার ২০১ ভোট পান। আর কোনো প্রার্থীর ভোট সংখ্যা হাজার ছোঁয়নি।
সবশেষ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে মহাজোটের প্রার্থী রাশেদ খান মেনন দাপুটে জয় পেয়েছিলেন।
এমএএস/এমকেআর/জেআইএম