দেশজুড়ে

পোড়াদহ মেলার আকর্ষণ ‘পাখি মাছ’

পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসের দিনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে বগুড়ার ঐতিহাসিক পোড়াদহ মাছের মেলা। প্রথা অনুযায়ী মাঘ মাষের শেষ বুধবার ইছামতী নদীর পাড়ে আয়োজিত উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম এ মেলা ‘সন্ন্যাস মেলা’ বা ‘জামাই মেলা’ নামেও সুপরিচিত। মেলায় এবারের আকর্ষণ ‘পাখি মাছ’।

বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার পূর্বে গাবতলী উপজেলার মহিষাবান গ্রামে ইছামতির তীরে পোড়াদহ এলাকায় এ মেলা বসে। ফলে মেলাটি সবার কাছে ‘পোড়াদহ’ মেলা নামেই সর্বাধিক পরিচিত।

জনশ্রুতি আছে, প্রায় ৪০০ বছর আগে মেলাস্থলে একটি বিশাল বটবৃক্ষ ছিল। সেখানে একদিন হঠাৎ এক সন্ন্যাসী আসেন। পরে সেখানে আশ্রম তৈরি করেন সন্ন্যাসীরা। একপর্যায়ে স্থানটি পুণ্যস্থানে পরিণত হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে। এরপর থেকে প্রতিবছর মাঘের শেষ বুধবার ওই স্থানে সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করেন তারা। কালের আবর্তনে স্থানটিতে লোকজনের উপস্থিতি বাড়তেই থাকে। এতো লোকের সমাগম হওয়ায় বসতে থাকে নানা রকম শৌখিন ও প্রয়োজনীয় পণ্যের পসরা। এভাবে শুরু হয় পোড়াদহ মেলা।

দিন দিন ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে সব ধর্মের মানুষের মেলবন্ধনে পরিণত হয় এ মেলা। মেলাটি একদিনের। তবে উৎসবের আমেজ থাকে সপ্তাহব্যাপী। নতুন জামাই-বউ ও স্বজনরা মিলে এ উৎসব করেন।

বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) মেলায় গিয়ে দেখা যায়, রীতি অনুযায়ী শ্বশুরবাড়িতে সবচেয়ে বড় মাছ কিনে নিয়ে যেতে চলছে জামাইদের নীরব প্রতিযোগিতা। এলাকার জামাই ছাড়াও আশপাশের ২৭ গ্রামের আত্মীয়-স্বজনে ভরে উঠেছে বাড়িগুলো। কেবল এলাকার মানুষ নয়, দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরাও আসেন ঐতিহ্যবাহী মেলাটির অভিজ্ঞতা নিতে। মাছের পাশাপাশি বিশাল আকার মিষ্টি আর নাগরদোলার ঘূর্ণিতে সময়টা উপভোগ করছেন সবাই।

একহাতে মিষ্টি ও আরেক হাতে মাছসহ মেলা চত্বরে দেখা হয় কাহালু উপজেলার বাসিন্দা আজাহার আলীর সঙ্গে। পাঁচ কেজি ওজনের সিলভার কার্প মাছ কিনেছেন দুই হাজার টাকায়। তিনি বলেন, ‘গ্রামের বন্ধুরা মিলে মেলায় ঘুরতে এসেছিলাম। মেলার মূল আকর্ষণ মাছ আর মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরছি।’

এবারের পোড়াদহ মেলায় পুকুর-নদী-বিলের তাজা রুই, কাতলা, বিগহেড কার্প, ব্লাডকার্প, বোয়াল, আইড়, পাঙাশ ছাড়াও উঠেছে বিভিন্ন সামুদ্রিক হিমায়িত মাছ। স্বাভাবিকের চেয়ে বড় আকারের এ মাছগুলো সচরাচর বাজারে দেখা যায় না। মেলা উপলক্ষে এসব মাছ বছরের পর বছর যত্ন সহকারে বড় করেন মাছচাষিরা। আয়োজক কমিটি বলছে, মেলায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মাছ বেচাকেনা হবে।

তবে বাঘাইড় বিলুপ্তপ্রায় মাছ হিসেবে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় থাকায় মেলায় বেচাকেনা হয়নি। এতে মেলার মূল আকর্ষণ কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। মেলায় এবার সবচেয়ে বড় মাছ ৪০ কেজি ওজনের গোলপাতা বা পাখি মাছ। টাঙ্গাইল জেলার বাসিন্দা ও সামুদ্রিক মাছের ব্যবসায়ী শরিফ তালুকদার মাছটি বিক্রির জন্য কক্সবাজার থেকে এনেছেন। প্রতিকেজি ১৫০০ টাকা দরে মাছটির দাম ৬০ হাজার টাকা দাবি করছেন এ ব্যবসায়ী। সামুদ্রিক এ মাছকে ঘিরে আশপাশে বেশ জটলা পাকিয়েছেন দর্শনার্থীরা। তাদের একজন রাজিব সেলিম বলেন, বহুবার নাম শুনলেও নিজ চোখে সামনে থেকে কখনো এ মাছ দেখিনি। এজন্য খুবই ভালো লাগছে।

মাছের পরেই পোড়াদহ মেলায় মূল আকর্ষণ মাছ আকৃতির মিষ্টি। প্রতিবছরের মতো এবারও মিষ্টান্নের দোকানগুলোতে মাছ আকৃতির মিষ্টি, রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলাপি, নিমকি, তিলের নাড়ু, খই, শুকনা মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় ১২ কেজি ওজনের মাছ আকৃতির মিষ্টি বানিয়েছেন আল-আমিন নামের এক যুবক। প্রতি কেজি ৫০০ টাকা দরে ছয় হাজার টাকায় তিনি এ মিষ্টি বিক্রি করবেন বলে জানান।

মেলায় বাহারি কসমেটিকস, খেলনা, উপহারসামগ্রী ও নারীদের নানারকম প্রসাধনী সামগ্রীর দোকান ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে মেলা প্রাঙ্গণে বিনোদনের নামে পুতুল নাচের প্যান্ডেলে অশালীন কার্যক্রম আর জুয়ার আসর বসায় পরিবারসহ আসা দর্শনার্থীরা পড়ছেন বিব্রত পরিস্থিতিতে।

এসআর/জিকেএস